সমস্ত লেখাগুলি

লঙ্কাকান্ড -
অশোক দাস চার্বাক
May 20, 2025 | নাটক | views:8 | likes:0 | share: 1 | comments:0

[নাটকটি বর্তমানের বঙ্গসমাজের বাস্তবচিত্র ভিত্তিক একটি কল্পচিত্র। বাস্তব ঘটনা বা বাস্তব চরিত্রের প্রতিফলন যে এ নাটকে থাকবে এটা অস্বীকার করা যায় না। তবে এ নাটকে কোন নির্দিষ্ট ঘটনা বা নির্দিষ্ট চরিত্রের ইঙ্গিত করে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্মানে আঘাত দেওয়া লেখকের উদ্দেশ্য নয়।]

চরিত্র:

মৃত্যুঞ্জয় - পুলিশ অফিসার                      

সুরজ - চাওয়ালা 

সর্বপ্রিয়া - অফিসারের  স্ত্রী                      

কালীপদ - মন্দিরের পূজারী            

শান্তিলতা - অফিসারের শাশুড়ী                

নান্টু - বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা 

হারাধন - অফিসারের শশুর                    

দুর্যোধন - অঞ্চলপ্রধান 

আশারাম - গুরুবাবা                              

পরানবাবু - উকিল 

ডঃ বোস - নার্সিংহোমের মালিক               

রিকশাওয়ালা          

শঙ্করবাবু - বৃদ্ধ প্রাক্তন শিক্ষক                  

টিভি সংবাদ পাঠিকা 

                           

    (পর্দা ওঠার আগে)

মাইক: ....................নাট্যসংস্থার পরিচালনায় অশোকদাস চার্বাক বিরচিত ও............ দ্বারা পরিমার্জিত যে অনুনাটকটির অভিনয় আপনারা সকৌতুকে উপভোগ করতে চলেছেন, তার হালকা রঙ্গব্যাঙ্গের আড়ালে প্রচ্ছন্নভাবে লুকিয়ে রয়েছে মানব প্রজাতির অবলুপ্তির দিকে অগ্রগতির এক ভয়াবহ ভবিষ্যতচিত্ৰ। হোমিনিড বংশোদ্ভূত হোমো স্যাপিয়েন অর্থাৎ ওয়াইজম্যান প্রজাতির পশুরা তাদের প্রকৃতিলব্ধ পশুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশঃ বিবর্তিত হতে হতে কিছুটা মানুষে রূপান্তরিত হয়ে পূর্ণসভ্য মানুষ হবার পথে বেশ ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু পশুসুলভ সংগ্রহকারী প্রবৃত্তি, অতিলোভ ও মাত্রাহীন ভোগবিলাসের লাগামছাড়া হাতছানি সদ্যবিবর্তিত অপরিণত মানুষকে পুনরায় পশুস্তরে পিছিয়ে নিয়ে চলেছে। মানুষ, অর্থাৎ যে প্রাণীদের আমাদের চলতি ভাষায় ‘মানুষ’ বলে থাকি - তারা ক্রমশ আগের মত মননহীন জন্তুত্ব অর্জন করতে চলেছে। মানুষ ও অন্যান্য পশুর চারিত্রিক পার্থক্য ক্রমশ কমে যাচ্ছে। তারা অন্যান্য পশুদের মত প্রতিযোগী পশুর সংগৃহীত করা খাদ্য বা প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ যেনতেনভাবে ছিনিয়ে নিচ্ছে। অপরের পুরুষ বা নারীসাথীকে নানান প্রলোভন দেখিয়ে বা গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিচ্ছে। তারা উন্মত্ত অসভ্য আদিম অর্ধমানবদের মত হাটে বাজারে, রিসর্ট মধুচক্রে নাচছে উদ্দাম উলঙ্গ হয়ে। আর আমরা টিভি সিনেমা থিয়েটার পথেঘাটে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে সে সব পশুনৃত্য লজ্জাহীনভাবে উপভোগ করছি আমাদের সন্তানদের সাথে। সেসব মজার দৃশ্য, সেসব রঙ্গব্যাঙ্গের দৃশ্য, সেসব কান্নার দৃশ্য, বিপথগামীদের অসহায় কালমৃত্যুর দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার আপনার প্রিয়জন ও সন্তানসন্ততির দুর্ভাগ্যের ভবিষ্যৎ দৃশ্য অনুমান করুন। তারপর নাট্যমঞ্চের শেষ পর্দা নেবে গেলে প্রাণভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এ সমাজের জতুগৃহ থেকে মুক্ত হবার পথ খুঁজতে থাকুন। অথবা, মানে ‘অথবা’ এ নাটকে দেখা পুলিশ, ডাক্তার, উকিল, পুরুত, গুরুবাবা, জ্যোতিষ বাবা, নেতাগুন্ডাদের ওপর আপনার একান্ত প্রিয় সন্তানসন্ততিদের রক্ষা করবার ভার অর্পণ করে আরও আরও সম্পদ বাড়াতে থাকুন, আর নিজ নিজ ভোগবিলাস চেটেপুটে উপভোগ করুন হলের বাইরে গিয়ে। আজকের নাটকে এতক্ষণ যা দেখবেন তা ভুলে যান। 


প্রথম দৃশ্য 

(নামাবলী গায়ে এক পাঠক রামায়ণ পড়ার সুরে পাঁচালী পাঠ করছে দুলে দুলে)

এ নাটকে দেখা যাবে প্রতি ঘরে ঘরে,

স্ত্রী পুত্র পরিবার একে একে মরে।

অসুরের স্বর্নপুরী পোড়ে সারে সার,

রাবনের দর্প ভেঙে হলো একাকার।

অসুর পুড়িছে তার কালো টাকা সনে,

লোভী মানি যোগী ধনী মরে জনে জনে।

ভোগের লালসা ধায় বিলাসীর গৃহদ্বার,

সে আগুন গ্রাস করে সুখী যত সংসার।

নেতা মন্ত্রী অফিসার সে আগুনে ঝাঁপ দেয়,

বৃদ্ধ যুবা শিশু পোড়ে পতঙ্গের মত হায়।

রচয়ে চার্বাক ঋষি কলির এ রামায়ণ,

স্বর্ণলঙ্কা দহনের নব এক রূপায়ণ।

ভাবিতে থাকহ এবে শ্রোতা সুধীজন,

বাঁচাইবে কি উপায়ে পুত্র প্রিয়জন।

অথবা চক্ষু মুদি মজা কর ঘরে,

না চিন্তি আগামী দিন পশু যাহা করে।

পুড়ুক এভাবে তব আপনার জন,

আগামী প্রজন্ম তরে করোনা মনন।

চক্ষু মুদি কর্ণ ঢাকি তিন হনু সম,

মুখ বুজি মন্ত্র জপ অসুরায় নমঃ।

শুষে নাও এ ধরায় আছে যত মধু,

লালসা মেটাতে তুমি ছুটে চল শুধু।

চার্বাক কথা শোন গরল সমান,

পোড়াইচ্ছে সারা ধরা যত হনুমান।

হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল,

হরিবোল,  হরিবোল, হরিবোল, হরি-ই-বোল।



দ্বিতীয় দৃশ্য 

[গ্ৰাম্য রাস্তার চৌমাথায় এক পথশনির ঠেকের পাশে চায়ের গুমটি। দূর থেকে ভেসে আসছে মোটরবাইকের আওয়াজ। চাওয়ালা চা চাপিয়ে দিল স্টোভে। বাইক থামিয়ে পুলিশ অফিসার মৃত্যুঞ্জয়ের  প্রবেশ]

সুরজ  - সেলাম সাহাব।

মৃত্যুঞ্জয় - চা চাপা শিগগির। আটটা বেজে গেল, এখনও উনুনের কয়লা কালো কেনরে শালা। 

সুরজ - মনটা বহুত উদাস হো গিয়া সাহাব। ঘরকা বহু প্রোমোটার কলিমুদ্দিনকা সাথ তিন দিন বেপাত্তা। বহুত সরম কি বাত। শুনা কি বকখালিমে ফুর্তিকে লিয়ে গিয়া হোগা। 

মৃ - এতে শরমের কি আছেরে পাগলা? এতো তোদের জাতের ছোটলোকদের বাড়ীর আখচার কারবার। ঘর ঘর কা কাহানি। মন খারাপ করিস না, আর একটাকে ধরে নিয়ে আয়। নে, চা চাপা। 

সু - চাপিয়েছি সরকার, দূর থেকে আপনার ইনফিল্ডের ডিগ ডিগ শুনে স্টোভেই চাপিয়ে দিয়েছে আপনার ইস্পেশাল চা। 

মৃ - বহুত আচ্ছা, কদিনেই বেশ ভালো বাংলা শিখছিস তো! বুদ্ধিটাও বেশ পেকেছে দেখছি বাংলার জল খেয়ে। 

সু - সব অপকাহি মেহেরবানী সাহাব। 

মৃ - ডাবল হাফ চা দিবি, আর ডাবল ডিম টোস্ট। 

সু - সব রেডি হো গিয়া সাহাব, আপকা মর্জি হামারা ধ্যানমে হ্যায়। 

মৃ - এইতো চাই। এই ভক্তি-বুদ্ধির জন্য তোরাই ব্যবসা জমাচ্ছিস সারা বাংলা জুড়ে। আর বোকচন্দর আঁতেল বাঙালীর বাচ্চারা শুধু দুর্নীতিবিরোধী মিটিং মিছিল প্রতিবাদ হরতাল করে করেই মরছে। বলে সমাজতন্ত্র আনবে, ন্যায়বিচার আনবে। শালা ওসব তন্ত্রমন্ত্র কি ধুয়ে খাবি? নিজের নিজের সংসার ছেলেমেয়েদের কথা ভাব। ওরা যে দিন দিন রসাতলে যাচ্চে সেটা আগে বোঝ। ইন্টেলেক্চুয়াল হয়েছে সব - বুদ্ধিজীবী!

সু - (চায়ের কাপ আর টোস্টের প্লেট টেবিলে রেখে)আউর কুছ সেবা সাহাব?

মৃ - এক প্যাকেট উইলস ছাড়। ক্লাসিক ফ্ল্যাসিকতো এ গাঁয়ে মিলবেনা। 

সু - নেহি সাহাব, স্রিফ আপকা লিয়ে চুপকে চুপকে লে আয়া শাহরসে। 

   (এদিক ওদিক তাকিয়ে প্যাকেটের সাথে পঞ্চাশ টাকার নোট রাখলো টেবিলে)

মৃ - এ কিরে শালা, পঞ্চাশেই সারবি নাকি? গত মাসেও তো চা বিস্কুটেই কর্তব্য সেরেছিলি। সেদিন দোকানে লাল পার্টির আগুনখেকো বদ ছোকরাগুলো ছিল বলে কিছু বলিনি। এমন করলে গভর্নমেন্ট চলবে, না দেশের মা মাটি মানুষ বাঁচবে! অন্ততঃ পুরো এক ছাড়। 

সু - বেচাকেনা একদম নেহি স্যার। 

মৃ - বললে হবে, ছোটঠা কাঁহাকা। একটা বেঞ্চতো বাড়িয়েছিস দেখি। তিন তিনটে বেঞ্চ ভরিয়ে কাদের বসাস। এটা পুলিশের চোখ, বুঝলি। বেশতো জাঁকিয়ে বসেছিস এ রাজ্যে এসে। সরকারি রাস্তা, সরকারী টিউকলের জল - সব তো ফুকোটসে। সরকারী রাস্তার জায়গাটাও তো জবরদখল। আর সেই সরকারের জন্য পঞ্চাশ! যারা তোদের অন্ন যোগাচ্ছে তাদের কথা একটু ভেবে দেখ। তোদের লালু ছাড়তো পঞ্চাশে? সামনের মাস থেকে দুই করে ছাড়বি। 

সু - মোর জায়গা সাহাব। 

মৃ - তা না হলে ইনকাম ট্যাক্স, সেলটাক্স, উনুনে কয়লা পোড়ানোর জন্য পরিবেশ দূষণ ট্যাক্স, - সব কেস একসাথে। - ধর ধর রিক্সাটাকে। সালা বড্ডো ফাঁকিবাজ। আমার বাইক দেখলেই স্পিড বাড়িয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ছুট মারে চোট্টাটা। জোচ্চোর একেবারে, অসৎ। 

[রুখ রুখ  বলে চেঁচাতে চেঁচাতে রাস্তার ওধারে গিয়ে রিক্সাটার হ্যান্ডেল চিপে ধরলো  সুরজ]

সু - বহুত মেহবান হো গিয়া শালা। সরকারকা বাইক দেখতা নেহি? সাহাবকো সেলাম দেগা কৌন? চল শালা বুড্ঢা। 

[কাঁধের গামছাটা কোমরে জড়িয়ে খোঁড়া রিক্সাওয়ালাটাকে  টানতে টানতে পুলিশের সামনে নিয়ে এলো সুরজ। দাদুর বয়সী বুড়ো  রিকশাওয়ালা পুলিশের  পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায়  ঠেকালো।]


রিকশাওয়ালা - বলুন বাবু। 

মৃ - বাবু! শালা, আমিকি তোর ইয়ারদোস্ত নাকি? স্যার বল, স্যার। বুড়ো হয়ে মরতে বসেছিস, ম্যানার্স জানিসনা? 

রিকশা - ভুল হয়ে গেছে বা- মানে স্যার (একটু জোরে) স্যার, স্যার। 

মৃ - বল শালা, রিকশায় প্যাঁপো বেল কিছু নেই কেন?

রিকসা  - প্যাঁপো একটা ছিল বা-স্যার, কদিন হলো চুরি হয়ে গেছে। 

মৃ - দিনের বেলাতেও ঘুমোস নাকি? লক্ষ্য রাখতে পারিসনা?

রিকষা  - আপনারা কিছু একটা ব্যবস্থা করুন সা-স্যার। বড্ড চুরি বেড়ে গেছে এদিকটায়। গত রাতে পঞ্চায়েত মিয়াঁর বিবিটাও বেপাত্তা হয়েছে। নাড়াপুর কালীমন্দিরের  পুরুত ঠাকুরের তিন তিনটে শুয়োর, আর চারটে  মুরগি চুরি হয়ে গেছে। জাগ্রতা মায়ের পেতলের জিভটাও কেটে নিয়ে গেছে চোরে। 

মৃ - তা, আমরা কি করবো? আমরা কি সাইকেলচোর, বৌচোর, মুরগিচোর, চাকরীচোর ধরতে বসে আছি নাকি? তাহলে সরকারী কাজটা করবে কে? যে নিজের মাল  নিজে নিজে সামলাগে যা। জাগ্রতা মাকালীকেও বলে দিস নিজের জিভ নিজে সামলাতে। 

রিকশা - যা বলবেন স্যার। চলি এখন?

মৃ - চলি কি রে? তিন মাসতো কিছুই দিসনি। এতো ধারবাকিতে চলে? একশো ছাড়।                                   রিকশা  - মরে যাবো স্যার, ট্যাঁকে মোটে পনেরো টাকা আছে। বৌ বাচ্চার জন্য চাল কিনতে হবে। 

মৃ - বাকি টাকা গেল কোথায়?

রিকশা - ভোর থেকে মাত্র দুটো খদ্দের পেয়েছি। তাও একজন আমার চেয়েও খোঁড়া - থুড়থুড়ে বুড়ি - বিধবা। যখন ওনার বাড়িটা ছিল, তখন উনি দু’দুটো বড় বড় অফিসারের মা ছিলেন। ছেলেদের নামে বাড়িটা লিখে দেবার পর ঘরছাড়া হয়ে রাস্তায় থাকেন, ভিক্ষা করে খান। বড্ডো জ্বর তাঁর। ওনার কাছে পয়সা নিতে পারলাম না স্যার। মানুষের মন, আমার আপনার বাড়িতেও তো বুড়ো বাপ মা আছেন। বুড়িকে হেলথ সেন্টারে পৌঁছে দিয়ে এলাম এমনি এমনি। 

মৃ  - কিন্তু সরকারতো ছাড়তে পারে না এমনি এমনি। তাকে নিয়ম আইন মেনে চলতে হয়। তা না হলে দেশে অরাজক হয়। প্যাঁপো না থাকায় সাংঘাতিক একটা কেস খেয়েছিস তুই। তোকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলে সরকারকে কি কৈফিয়ৎ দেব? সরকারতো এজন্যই আমাদের মাসে মাসে মাইনে দিয়ে রেখেছে। এয়াই সুরজ দেখতো সার্চ করে, ওর ট্যাঁকে কত আছে। 

           [সুরজ রিক্সাওয়ালার ট্যাঁক সার্চ করলো]

সুরজ - পঁয়ত্রিশ রুপিয়া স্যার। সালা ছোটঠা আদমি। সরকারকো ভি ফাঁকি দেতাহা!  ইতনা বাদমে তো নবান্ন রাজভবন ভি লুট লেগা শালা। 

মৃ  - দশ  টাকা ওকে দিয়ে বাকিটা নিয়ে আয়। ৭৫ টাকা মাফ করে দিলাম এক কথায়। ১০০ টাকার কেস ২৫ টাকায় নিস্পত্তি। তবু অনেকে পুলিশকে ঘুষখোর বলে। [তাড়াহুড়ো করে রিক্সাওয়ালার ছুটতে ছুটতে প্রস্থান] সুরোজ, এই টাকা থেকে তুই দু’টাকা বকশিস রাখ। তোর ইন্টারভিউ হয়ে গেলো। দারুন কাজ করলি। এবার একটা ভালো সরকারী চাকরী কিনে  নে। বড় নেতাকে  বলে অল্প দামে সিভিক ভলেন্টিয়ারের চাকুরী করে দেব তোর। এভাবেই আমাকে সাহায্য করবি। সবার সামনে সরকারি  কাজ করতে পারি না। চারিদিকে মিডিয়ারা ক্যামেরা নিয়ে ঘুরছে। আমার হয়ে ট্রাক লরি থেকে জরিমানা আদায় করবি তুই। সরকারী মাইনে  ছাড়া আমার কাছ থেকে কমিশনও  পাবি। 


     [বৃদ্ধ শঙ্করবাবুর  প্রবেশ। হাতের প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে সবজি  দেখা যাচ্ছে। মাথায় তালি  দেওয়া ভাঙা ছাতা। চায়ের কাপটা তাড়াতাড়ি শেষ করে মৃত্যুঞ্জয়  ছুটে এগিয়ে গেলো ওনার দিকে।] 

মৃ - ভালো আছেন স্যার?(প্রণাম) 

শঙ্করবাবু – তোমায় তো ঠিক চিনতে পারলামনা বাবা। চোখেও ভালো দেখিনা ...

মৃ - আমি মৃত্যুঞ্জয়, মৃত্যুঞ্জয় মন্ডল। আপনার ছাত্র ছিলাম। বারে বারে ফেল করতাম বলে ফেলুরাম বোকারাম বলে ডাকতেন আদর করে। আমাকে পাস করানোর জন্য আলাদা করে বিনা পয়সায় পড়াতেন আপনার বাড়িতে। 

শঙ্কর - মৃত্যুঞ্জয়, হাঁ হাঁ মনে পড়েছে বটে। আশুর ছেলেতো। বড্ড ভালো মানুষ ছিল তোমার বাবা। খড় দিয়ে ঘর ছাইতো নিখুঁত। নিজে লেখাপড়া করতে পারেনি বলে তোমাকে পড়িয়ে পড়াশুনার স্বাদ মেটাতো। জনমজুর খেটে আধপেটা খেয়ে তোমাকে পড়াতো। স্বার্থক হয়েছে তার পরিশ্রম। পুলিশ অফিসার হয়েছো বুঝি। 

মৃ - হাঁ স্যার, ঝাড়বুনি থানার সেকেন্ড অফিসার। চা খান মাস্টারমশাই।  

শ - তা, আশুর মত সোজা সরল সৎ মানুষের ছেলে হয়ে পুলিশ লাইনে এলে  কেন? অবশ্য পুলিশের মধ্যে অনেক সৎ মানুষও আছেন। তবে নেতা মন্ত্রী পুলিশের নামে লোকে আজেবাজে কথা বলে, মানসম্মান রাখে না শুনি। 

মৃ - মানসম্মান নিয়ে কি ধুয়ে খাব নাকি? ওসব সেকেলে সেন্টিমেন্টকে পাত্তা দিলে আর করে খেতে হবে না। 

শ - তাবলে এ লাইনে? অন্য চাকরী ধর।

মৃ - সব লাইন একই মাস্টারমশাই, সব শালা- সরি, মানে  সব ভদ্রলোকই চোর। আপনাদের শিক্ষকরাইতো কোচিং সেন্টার ফেন্টার খুলে কোশ্চেন বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাচ্ছে। নেতা মন্ত্রীদের ঘুষ দিয়ে নিরক্ষররা সরকারী অফিসার, বোর্ডের চেয়ারম্যান, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়ে যাচ্ছে। এখনকার দিনকাল পাল্টিয়ে গেছে মাস্টারমশাই। এখন মা-মাটি-মানুষের সরকার। সব সময় পাশে থাকে। ডাকলেই দুয়ারে হাজির। 

শ - ক্লাস সিক্সে তিন বার আটকিয়ে থেকে স্কুল ছেড়ে বাবার সাথে চাষবাস দিনমজুরি করা শুরু করেছিলে শুনেছিলাম। অফিসারের চাকরি পেলে কি করে? পরে প্রাইভেটে পাস্ করেছিলে বুঝি?

মৃ - সে এক মজার ইতিহাস মাস্টারমশাই। ভোট করাতে গিয়ে রাজনীতি লাইনে একটু নামডাক-চেনাশোনা হয়েছিল। কাউকে ঘেঁষতে দিতাম না বুথে। নয়খুনি নান্টু, মেছো অনুকেষ্টরা এখন বড় বড় নেতা হয়েছেন। টুঁকুলি মন্টুকে মনে আছে স্যার? স্কুল থেকে বহিস্কৃত হয়ে সে ছাত্রনেতা হয়ে গেছিল। সে এখন এম এ পাস করে ডক্টরেট পেয়ে গেল বিহার বিশ্ববিদ্যলয় থেকে। ওখানে বেশ সস্তায় ডিগ্রি পাওয়া যায়। পরীক্ষা টোরিক্ষা কিচ্ছু দিতে হয়না। সে, মানে তিনি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী হয়ে শিক্ষকদেরই সহবত শেখাচ্ছেন। বড় শহরে  পোস্টিং পাবার জন্যে কত আচ্ছা আচ্চা শিক্ষক অধ্যাপক, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত ব্যাগে প্যাকেট খাম লুকিয়ে ওঁর চেম্বারে ধর্ণা দিচ্ছে। 

শ - বল কি বাবা, এত উন্নতি করেছে মন্টু!

মৃ - ওনারাই বললেন, বাপের অবস্থাতো দেখলি। চাষবাস বা খড়ের ঘর ছেয়ে  আর কয় পয়সা কামাবি, এখনকার বৌ বাচ্চাদের খাঁই মেটাতে পারবিনা। দিনকাল পাল্টেছে। চাহিদামত ফুর্তির রসদ না পেলে ছেলেমেয়েরা ঘেন্না করবে, বৌ হেটেল রিসোর্টে ছুটবে রাতের মজা লুটতে। তুইতো বেশ হাতফাৎ চালাতে, খিস্তি খেউর করতে পারিস মাননীয় নেতামন্ত্রীদের মত। সেকারনে গাঁয়ের লোকেরা ভয়ে ভয়ে তোকে সমীহও করে। সামনের ভোটের আগে কদিন স্বেচ্ছায় মানুষের সেবা কর। ভোটের পরে নেতাদের বলে কয়ে সামান্য খরচে পুলিশে ঢুকিয়ে দেব তোকে। তুই আমাদের দেখবি, আমরাও তোরটা। দু বছরে গাড়ি বাড়ি সম্মান - সব হয়ে যাবে। তাই স্যার, বাবার ভিটেটা বেচে লাখ তিনেকে চাকরিটা পেয়ে গেলাম। মাধ্যমিক সার্টিফিকেটটাও ফ্রি পেয়ে গেলাম এক্সট্রা। 

শ - এসবতো অশ্লীল অসভ্য লেখকদের গল্প নাটকের মত মনে হচ্ছে। তুমি কি সত্যি বলছ? 

মৃ - একদম সত্যি। এসব হচ্ছে উন্নততর প্রশাসনের আধুনিক টেকনোলজি। নিন আর এক কাপ চা খান। বলেনতো তিন চার লাখে আপনার বেকার ছেলেরও  এমনি একটা হিল্লে করে দিতে পারি। বড় বড় জায়গায় আমার কন্টাক্ট আছে। আপনারও ভালো, আবার দু পয়সা আমার পকেটেও  ঢোকে। 

শ - ছি ছি বাবা। ওসব খারাপ কথা থাক। সৎভাবে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন কর। পাপকে কখনও মনে ঠাঁই দেবেনা। পাপের পয়সা কখনও ঘরে ঢোকাবেনা। রাতে ঘুম হবেনা। ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাবে, সংসার জীবন সুখের হবেনা। তোমার বাবামায়েরা ভাল আছেনতো?

মৃ - অনেকদিন হল ওদের খবর পাইনি। 

শ - সে কি! কোথায় থাকেন ওঁরা? বহু কষ্টে মাটির বাড়িটা বানাতে দেখেছিলাম। 

মৃ - প্রথমের দিকে আমার সাথে ঐ বাড়িতেই থাকত। আমার বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বিধবা দিদির বাড়ী চলে গেলেন আপনার বৌমার সাথে ঝগড়া করে। নিঃসন্তান দিদি মারা গেলে পার্টি সিন্ডিকেটের এক প্রোমোটার দিদির বাড়িটার দখল নিলো আমায় দুই আর পার্টিকে দুই দিয়ে। তারপর দিদির বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ওরা  কোথায় গেছিল জানা নেই। লোক পরম্পরায় শুনি ওরা  নাকি গত বছর একই দিনে মারা গেছেন মাদারের আশ্রমে। ওরাও নিশ্চিন্ত, আমরাও। 

শ - সে কি কথা! তুমি ওদের একমাত্র উপযুক্ত ছেলে, গায়ের রক্ত জল করে তোমায় মানুষ করেছেন, মরণকালে শেষ জলটুকু পেলেননা তোমার হাতে!

মৃ - কি করব বলুন,বুড়ো বয়সে বড্ড বেগড়বাই করছিল। সারা বছর বুড়োবুড়ির দাঁত ব্যাথা, হাঁপানি, বাতবেদনা, ছানি - মানে নানা অপব্যয় আর অশান্তি। তারওপর আবার নানা বায়নাক্কা - মাঝ রাত বিরেতে কোথায় যায় বৌমা, চুল ছোট করে কাটে কেন, ফেরার সময় মুখে বাজে গন্ধ কেন, মানে আপনার বৌমা ওদের গোয়েন্দাগিরির ঠেলায় একেবারে অতিষ্ট। সংসার ছারখার। 

শ - থাক বাবা থাক, আর বলতে হবেনা। ঠাকুর তোমার সুমতি দিন, তোমাদের চৈতন্য হোক। ছেলেমেয়েরা যেন তোমাদের দেখে বুড়ো বয়সে। 

মৃ - আমিও আপনার মত বেলুড় মঠের শিষ্য। আমার ঔরসে, আমার রক্তমাংসে তৈরী আমার ছেলেমেয়েরা কোনোদিন কুসন্তান হবেনা, এ আমি নিশ্চিত। 

শ - তুমিও কি তোমার বাপ মায়ের রক্তমাংসে সৃষ্ট হওনি নাকি। তুমি ওঁদের তাড়ালে কি করে? ওঁরাওতো ধার্মিক ছিলেন তোমার মত। মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিতেন, দেব দ্বিজে ভক্তি ছিল, অনুকূলবাবুর সৎসঙ্গে দীক্ষা নিয়ে নিরামিষ খেতেন  .......

মৃ - বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরে বহুত তর্ক শিখে গেছেন দেখছি। পুলিশের সাথেও তক্ক! এত সাহস! পন্ডিত হয়ে গেলেন, না বামবাদী? বাঁকা কথায় গালাগাল দিচ্ছেন! ভালো প্রস্তাব দিলাম, মনে ধরলোনা। বাজে কথা ছেড়ে এবার সরকারী কথায় আসুন। বাজারে গিয়েছিলেন বুঝি?

শ - আমাদের আবার বাজার। ওই কুমড়ো, কুদরী, কলমি, কচু - এইসব আর কি। সবই তো দুনম্বরী প্রোমোটার, পার্টিফড়ে হঠাৎ-বাদশারা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। 

মৃ -সবইতো বুঝলাম, কিন্তু প্লাস্টিক ব্যাগে আনাজ আনতে গেলেন কেন? ফালতু একটা কেস খেয়ে গেলেন সক্কালবেলা। 

শ - এইটুকুতো সবজি, ব্যাগটা কদিন আগে ছিঁড়ে গেছে বাবা। 

মৃ - পাতলা প্লাস্টিকে বাজার আনা বেআইনী সেটাকি জানেননা?

শ - জানি বৈকি বাবা। কিন্তু সবার হাতেই তো দেখি। তোমাদের পুলিশরাও তো দেখি ঐ ব্যাগে বাজার করে। 

মৃ - আপনিকি আজকাল পুলিসের ওপরেও পুলিশগিরি করছেন নাকি? জেল হয়ে যাবে যে। নেতা পুলিশের নামে এমন কুৎসা ছড়ানো ব্ল্যাসফেমির মত কগনিজেবল অফেন্স এটা কি জানেননা? ফের আবার প্রশাসনের নামে এমন কুৎসা করলে সোজা হাজতে পুরে এক্কেবারে অম্বিকেশ করে ছেড়ে দেব। 

শ-ছিঃ ছিঃ, পুলিশ হয়েছো বলে কি শিক্ষকদের সাথেও ঠাট্টা মস্করা করবে নাকি? চলি এখন। 

মৃ - চলি মানে? কোথায় পালাবেন আমার হাত থেকে। রাস্তায় বিড়ি খাবার কেসটা না হয় ছেড়ে দিয়ে গুরু ঋণ শোধ করলাম। আপনিও আমার বাল্যকালে আমায় বিড়ি খেতে দেখে শুধু আলতো করে কান মলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু প্লাস্টিক কেসটা চোখ বুজে ছেড়ে দিলে সরকার থাকবে, না আমার চাকরী। 

শ - তুমিও আমার কান মোলে ছেড়ে দাও বাবা। 

মৃ - একি বলছেন মাস্টারমশায়। আপনি আমার গুরু। শাস্ত্রে বলে আচার্য দেব ভব। আপনার কানে হাত দিয়ে আমি কি মহাপাতকী হবো নাকি। পাবলিকই বা কি বলবে, আবার ভগবানই বা কি বলবে। 

শ - তাহলে কি করে তোমার হাত থেকে রেহাই পাবো বাবা?

মৃ - ওটা আমার হাত নয় মাস্টারমশাই। ওটা সরকারের হাত, মানে আইনের হাত। আর ও হাতটা জনগণই বানিয়েছে। আপনিও বানিয়েছেন ভোট দিয়ে। শুনুন মাস্টারমশাই, আমি হিসাব করে দেখলাম পুলিশ কেস হয়ে গেলে আপনার পরিশ্রম, হয়রানি, ছুটাছুটি, দুশ্চিন্তা, তার উপর থানা খরচা, পার্টি খরচতো আছেই। উপরন্তু আদালতে কতবার যে ডেট পড়বে তার ঠিক নেই। তার জন্য প্রতিবারে উকিলের ফি, কেরানির ‘আমরা পেয়ে থাকি’, পিওনের বকশিস, সাক্ষীর জলপানি - রাহা খরচ....

শ - সাক্ষী? সাক্ষী কোথায় এ জনহীন মাঠে?  

মৃ - সব আছে মাস্টার, সব আছে। সব কি খালি চোখে দেখা যায়, না সবাই সব কিছু দেখতে পায়। সাক্ষীরা সব দেব দেবীদের মত অলক্ষে অন্তরীক্ষে থাকে। সাধুসন্ত মুনিঋষিরা যেমন গাঞ্জা সেবন করে অদৃশ্য ভগবান দেবদেবীদের দেখতে পায়, তেমনি একমাত্র উকিল আর পুলিশরাও সাক্ষীদের দেখতে পায়, সাক্ষীরা তাদের ডাকে সাড়া দেয়। একবার হাঁকিয়ে দেব, আর জনা বিশেক মান্নিগন্নি বাবুলোকেরা আদালতে গীতা ছুঁয়ে বলবে যে আপনি কর্তব্যরত পুলিশকে জুতোপেটাও করেছেন। তখন ঘটিবাটি বেচেও জেলযাত্রা ঠেকাতে পারবেননা। আজীবন  আপনার কেসটা চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে। আর আপনার মরার পর উত্তরাধিকার সূত্রে আপনার বেকার পুত্রের ঘাড়ে চেপে বসবে তার দায়। নিন, দশ  হাজার ছাড়ুন। 

শ - এতো টাকা আমি কোথায় পাবো বাবা। তার চেয়ে আমায় বেঁধে তাঁদের নিয়ে যাও। 

মৃ - এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন মাস্টারমশায়? পুলিশ বলে আমরা কি মানুষ নই নাকি। আমরাকি একেবারে চশমখোর শুওরের বাচ্চা যে পরম পূজনীয় বৃদ্ধ মাস্টারমশাইয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে জেল খাটাবো। আমরা নিরপেক্ষ সরকারী কর্মী হলেও আমাদের পাঁজরের নিচে একটা দুর্বল নরম মন রয়েছে। সে মনে লাজ লজ্জা,ন্যায়বোধ মনুষ্যত্ববোধ যে একেবারেই শূন্য তা নয়। আপনার জন্য সামান্য কিছু করতে পারলে শিক্ষাগুরুর ঋণের বোঝাটার কিছুটা লাঘব হয়। আমাদের মহামান্য মন্ত্রী বলেছেন নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা ভুলে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। তাঁদের সে বাণীতে আনুপ্রানিত হয়ে মাত্র ছয় হাজারে কেসটার  ফয়সালা করে দেব। দশ থেকে একেবারে ছয়। সক্কালবেলা স্রেফ ফোঁকেটসে আপনার চার হাজার টাকা ইনকাম। এবার হাসুন। না না, এখুনি দিতে হবেনা। বাজার হয়ে গেছে।এবার বাড়ি যান, ভালোমন্দ খান, আনন্দফুর্তি করুন, সন্ধ্যে হলে দিয়ে সরকারি জরিমানার টাকাটা আমার সিভিক সেচ্ছাসেবক গিন্নীর কাছে জমা করে আসবেন। সরকারী জরিমানা কমিয়ে দিয়েছি বলে আবার পাঁচকান করবেন না যেন। আপনাদের ঐ মিডিয়া, আর অর্ধশিক্ষিত জনগণ তা বুঝবে না। ঘুষ খেয়ে চার হাজার টাকা পাইয়ে দিয়েছি বলে কুৎসা রটাবে। অসভ্য নাট্যকারেরা  নাটক লিখবে, অশিক্ষিত লেখকেরা গল্প লিখবে, টিভিতে তর্ক বিতর্ক করে গলা ফাটাবে - মনে হয় সবকটাকে ধরে ধরে অথবা - যান এখন নয়টার বাসটা পৌঁছুবার আগে কেটে পড়ুন। 


(শঙ্করবাবুর দ্রুত প্রস্থান) শালা শ্বশুরমশাইয়ের মোপেড মনে হচ্ছে। শালার ব্যাটা হাড়কেপ্পন। বছরের পর বছর জামাইষষ্ঠী, পুজোর কাপড় সব ফাঁকি দিয়েছে সুদখোর হারামির বাচ্চা। পুলিশের শ্বশুর পরিচয় ভাঙিয়ে এর কলা, ওর মুলো, ডিম, মুরগী বিনে পয়সায় বাগিয়ে বৌয়ের কাছে ফাঁট মারে। গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে আধা দামে চাল ডাল কেনে, রেশন দোকান আর স্কুলের মিডডে মিলের ডিমের বখরা নেয় রাঁধুনি মাস্টারদের কাছ থেকে। আর জামাইয়ের বেলায় লবডঙ্কা। শুওরের ইয়েটাকে আজ একটা কেস না দিলে সরকারের মান ইজ্জত থাকবেনা। (হারাধনবাবু মোপেডটা রাস্তায় স্ট্যান্ড করিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকলেন। গলায় তুলসীর মালা, কপালে গলায় হাতে চন্দনের ছাপ। মুখে গ্রামীণ সুদখোর সুদখোর ভক্ত ভক্ত ভাব।) ভালো আছেন বাবা?

হারাধন - ও তুমি! চিনতেই পারিনি। টুপিটা বেশ মানিয়েছে কিন্তু। সাহেব সাহেব লাগছে দেখতে। মনে হয় সেই ছোট বেলায় দেখা গোরা পুলিশ। তবে ওদের সোলার হ্যাটটা থাকলে আরও মানাতো। অবশ্য আর সব একই। সেই এক ব্যাটন, সেই লাল লাল চোখ, তেজিতেজি মুখ খিস্তি। তোমার শাসনের প্রশংসা শুনি গ্রামে গ্রামে। মেনিমুখো মিষ্টি মিষ্টি ভদ্র ভদ্র পুলিশ আমার ভালো লাগেনা। সাহেবরা আমাদের দেশটাকে দেশি নেতাদের দান করে গেছে বটে, কিন্তু ওদের বাজখাঁই মেজাজটা শুধু পুলিশকেই দিয়ে গেছে। না হলে এই অশিক্ষিত ছোটলোকদের সামলানো মুশকিল হোত, দেশের আইন কানুন কেউ মানতোনা, অসৎ ছোটলোকগুলো মাথায় চড়ে বসত। বেশির ভাগ না হলেও তোমার মত দু-চারজন কড়া পুলিশ, কড়া নেতামন্ত্রী আছে বলেই দেশে চন্দ্র সূর্য উঠছে এখনও। 

মৃ - ঠিক বলেছেন বাবা। কিন্তু ঐ ভুঁইফোঁড় গণতন্ত্রপন্থী মানবাধিকারবাদীরা এই সোজা কথাটা বোঝেনা। (সুরজ চা বিস্কুট টেবিলে রেখে গেল) একটা ডিমটোস্ট দিয়ে যা শ্বশুরমশাইকে। চিনিসনা ওনাকে?

সু - কসুর হো গিয়া সাহেব। 

হারা - আশীর্বাদ করি আরও বড় অফিসার হও। ভাটিখানায় চললে বুঝি? শালা লোকনাথটা বড্ড বাড় বেড়েছে। একটু ধমকে দিয়ে এসোতো বাবা। শালা শুদ্দু জল মেশাচ্ছে। দুটো গিলেও নেশা হয়না। যাও ওখানে একটু ফুর্তি করে এস। 

মৃ - আমাদের কি ফুর্তি করার সময় আছে বাবা। এ গ্র্রামে সরকারী ডিউটিতে বেরিয়েছি। ডিউটির সময় ওসব চলেনা। কর্তব্য আগে। 

হারা - বেশ বেশ, এই তো কর্তব্যপরায়ণ পুলিশের মত কথা। সময় পেলে তোমার শাশুড়ি ঠাকরুনের সাথে একটু দেখা করে যেও সবাই মিলে। দাদুভাই দিদিভাইদের দেখিনি অনেকদিন। চলি তাহলে। 

মৃ - চলি মানে? হেলমেট পারেননি কেন?

হারা - এইতো হেলমেট। 

মৃ - হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখলেই কি আইন বাঁচানো হয়ে গেল, ওটা মাথায় পরতে হয়। 

হারা - এই, গাঁয়ে গঞ্জে কে আর দেখছে। শহরের দিকে গেলে পুলিশ শালাদের তোলা জুলুমের ভয়ে মাথায় গলিয়ে নেই হ্যান্ডেল থেকে বার করে। 

মৃ - খুব বেআইনী করেন। মিছিমিছি একটা কেস খেয়ে গেলেন। 

হারা - সেকি, কবে, কখন, কোথায়, কে কেস দিলো?

মৃ - এইতো এখুনি, আমিই তো দেখলাম আপনার হেলমেটের জায়গায় শুধু তেল চকচকে টাকটা ঝিলিক মারছে সকালের রোদ্দুর পেয়ে। 

হারা - ওহ, এই কথা, তুমি আমার জামাই হয়ে আমার বিরুদ্ধে কেস দেবে নাকি?

তোমার রসবোধ বেড়েছে দেখছি, হা হা হা, তুমি দেখলেও কেস হবে? 

মৃ - হবেনা কেন, এই উর্দিটা পরলে আমি হয়ে যাই শুধু একজন পুলিশ। আপনার জামাইতো তো দূরের কথা, একজন মানুষও থাকিনা তখন। বিচারকদের টেবিলে চোখবাঁধা আইনদেবতার মূর্তী দেখেননি? হাতের দাঁড়িপাল্লার এক পাশে পিনাল কোডের গীতা, আর অন্যটায় জরিমানার টাকা বা জেলখানার চাবি। 

হারা - এইবারটি আমায় ছেড়ে দাও বাবা। 

মৃ - তা হয়না বাবা। মহাপাপ হবে। গীতা হাতে নিয়ে দিব্যি গেলে চাকরীতে যোগ দিয়েছি। সরকারের সাথে বেইমানি করে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করতে পারবনা। পুলিশের কাজ বড় কঠিন, বড় নির্দয় বাবা। একে বলে ন্যায়দন্ড। আমার কাছে রাস্তাঘাটের দুষ্কৃতী, নিজের বাড়ীর বাপ, শ্বশুরবাড়ীর বাবা, ভাই বোন, স্ত্রীপুত্র, চোর-ডাকাত, কুনাল, নীরব মোদী, সরব মোদী, মোহিত শাহ - নাসিরুদ্দিন শাহ  - সব সমান। আপনি যখন আপনার ক্যান্সার আক্রান্ত ভাইপোর কাছে সুদ নেন, তখন আপনি আর জ্যাঠামশাই থাকেননা, শুধু একজন সুদখোর। নিন, সামান্য পাঁচ হাজার খসান। 

হারা - সামান্য হেলমেট না পরার জন্য পাঁচ!

মৃ - রাস্তায় পেচ্ছাপ করার জরিমানা যোগ করে পাঁচ। 

হা - পেচ্ছাপ? রাস্তায়? কখন পেচ্ছাপ করলাম বাবা? আমিতো মোপেড থাকে নেবে সোজা এই দোকানে ঢুকলাম তোমার চোখের সামনে। 

মৃ -বললে হবে, আমি স্পষ্ট দেখলাম আপনি ঐ-ই বাবলা গাছটার পাশে নামলেন, মোপেডটা স্ট্যান্ড করালেন, তারপর বোতাম খুলে ...আমি পরিষ্কার সব দৃশ্য দেখলাম, ফুটবল খেলার মত ধারাবিবরণ দিয়ে দেব নিখুঁতভাবে। মনে রাখবেন এটা পুলিশের চোখ। পুঞ্জাক্ষী। যেন একশো ডিজিটাল ক্যামেরা এক সাথে জুম করছে। সাধুসন্ত পীর পয়গম্বররা যেমন করে তাদের বৈদিক টেকনোলজিতে ত্রিকাল ত্রিভুবন দেখে। দেখলেও দেখে, আবার না দেখলেও দেখে। একে বলে আধ্যাত্বিক দৃষ্টি। কোন পাপ লুকানো যায়না ভগবান, আর পুলিশের চোখে। তা সে বাবলা গাছের আড়ালেই হোক, কি প্যান্টের ...

হা - তুমি সত্যি সব দেখেছো আমার ইয়ে - মানে। ..

মৃ - তাহলে আর বলছি কি। আপনি আমার বাবা, শুদ্ধ ব্যাকরণে উপবাপ, মানে কোয়াশি বাপ। মানে বাবার মত। জামাই হয়ে ওসব বেআইনি পাপ দেখা একটু অশ্লীল হয়ে গেছে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জজসাহেবের সামনে বর্ণনা দিতে পারবোনা পুরো দৃশ্যটা। কিন্তু সরকারি কাজ বলে কথা। লাজলজ্জা করলে সরকারি কর্তব্য পালন করা যায়না। 

হা - তুমি নিশ্চই ভুল দেখেছো। ও জিনিসটা আমার নয়,অন্য কোন লোকের। 

মৃ - পুলিশ ভুল দেখেছে! এরপরতো বলবেন ভগবানের চোখে ছানি পড়েছে। আই সুরজ - হা করে শুনছিস কি? বলনা কি দেখছিস তুই। 

সুরজ - হাঁ শাশুড়বাবু, হামিওভি দেখেছে পাপটা। ওটা থেকে ছড়ছড় করে - আমাদের সরকার কখনও ভুল দেখেনা। 

মৃ – শুনলেন তো, আর অন্য কোন সাক্ষীর কথা বলছেন? ঐ যে পীরপুরের বাসটা  আসছে, ও বাসের প্যাসেঞ্জেররাও সব কিছু দেখেছে বলবে গীতা হাতে নিয়ে।  

হা - সব বুঝলাম বাবা, বড্ডো কড়া স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশের আইন। ক্ষুদিরাম-মাতঙ্গিনী, গান্ধী-নেতাজিদের  প্রাণ বিসর্জন স্বার্থক। স্বর্গ থেকে তোমাদের ন্যায়বিচার দেখে তাঁদের আত্মার নিশ্চই শান্তি হচ্ছে। আমারও তুমি মনের মত উপযুক্ত জামাই হয়েছো। তোমার আইনজ্ঞান, নীতিজ্ঞান কাজকর্ম জেনে মনে বড় গর্ব হল। বল, এখন কি করতে হবে। 

হা - আপনি আমার নিজের বাপের চেয়েও বেশি বাবা। সম্মান দিয়ে বাপ বলে ডাকি। আমার গিন্নীও তার মাতৃবাক্যকে বিশ্বাস করে আপনাকে বাবা বলে স্বীকার করে। কোন সন্দেহ করে না। আমার ভাগের কাটমানি ছেড়ে দিয়ে তিনেই ছেড়ে দেব পিতৃসম্মানে। কি, এবার খুশিতো? গুরুজনদের খুশি করতে পারলে আমার মনে খুব মজা-আনন্দ হয়। 

হারা - সেকি বাবা, জামাই হয়ে ঘুষ নেবে আমার কাছে? 

মৃ - (কানে হাত দিয়ে) ছি ছি বাবা, এমন কথা শোনাও পাপ। লোকে শুনলে আমায় অসৎ বলে ভাববে। আর যদি ঘুষও হয়, মনে মনে ভাবুননা কেন যে মেয়ে নাতি নাতনিদের মিষ্টি খাবার জন্য ... না না, এখনই না দিলে যে সাধারণ ক্রিমিনালদের মত হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নিয়ে যাবো এমন চশমখোর জামাই আমি নই। আমি গুরুজনদের খুব শ্রদ্ধাভক্তি করি। ভাইপোর কাছ থেকে সুদ আদায়ের যে টাকাটা খানিক আগে পকেটে ঢুকিয়েছেন সেটা এখন জমা করে বাকিটা শালাবাবুকে দিয়ে থানায় পাঠিয়ে দেবেন। পাঁচের কেস তিন হাজারেই ফয়সালা হয়ে গেলো। সক্কালবেলা দুই হাজার ইনকাম আপনার। এবার হাসুন। (হারাধনের পা ছুঁয়ে প্রণাম -  মাইকে সমবেত হাস্য)

                          


তৃতীয় দৃশ্য

 পঞ্চায়েত অফিস। (অঞ্চল পঞ্চায়েত দুর্যোধন চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে সিগারেট টানছে। কয়েকজন গুন্ডামার্কা ছোকরা  মেঝেতে এদিক ওদিক বসে মদ খাচ্ছে। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ)

দুর্যোধন - এস এস সাহেব, টুলটায় বস। পাঁচ মিনিট। (ছেলেদের উদ্দেশে)

তাহলে আজ রাতেই কাজটা শেষ করে আয়। ঐ এরিয়ার থানাকে বলা আছে। কোন চিন্তা নেই তোদের। মাঠের ওপার থেকে নজরে রাখবে। সাদা পোশাকে। লাশটা ন্যাংটো করে মুখটা থেথলে অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে পাশের ডোবাটায় পুঁতে দিবি। কেউ এসে গেলে তার নলিটাও চিরে দিবি। তারপর ওর  সদ্যবিধবা দুঃখী বৌটাকে সবাই মিলে একটু আনন্দ দিয়ে আসবি। শালা নান্টুর আস্কারা পেয়ে শুওরের ইয়েটা বড্ড বাড় বেড়েছিল। এবার কে আমার ভাটিখানা তোলে দেখি। আপাতত: এই পঞ্চাশ হাজার  রাখ। (টাকার বান্ডিল ছুঁড়ে দিলো এক ছোকরার দিকে। মৃত্যুঞ্জয় মিটি মিটি হাসতে হাসতে সব কিছু দেখতে থাকলো। ছোকরাগুলো  ছোরা ছুরিগুলো ব্যাগে পুরে প্রস্থান করলো) এবার বল মেজসাহেব, কেমন আছো? মেজোয় প্রমোশন হবার পর থেকে তো সাহেবের টিকিটাও দেখতে পাচ্ছিনা আজকাল। 

মৃ - কেন স্যার, শুধু গত মাসেরটাই দিতে আসতে পারিনি। টিভি ক্যামেরারা যা পেছনে লাগছে! কারো ভালো দেখতে পারে না ওরা। শুধু হিংসা আর কুৎসা। মন্ত্রীরাই ওদের বাগে আনতে পারছেনা। 

দু - কিন্তু তার আগের মাসের ওই মোনার বিধবার উচ্ছেদেরটাওতো বাকি। 

মৃ - সব হয়ে যাবে স্যার। প্রমোটারটা একটু ফাঁপরে পড়েছে। রিয়েল এস্টেটের বাজার খুব খারাপ। এদিকে আবার জমি দখল হলেও পাশের পুকুর বোজানোটা বাকি। সেখানেও বাগড়া দিচ্ছে স্থানীয় জলাভূমি বাঁচাও সমিতি। তবে সরকারী অনুদান দেওয়া ক্লাবের মেম্বারদের ম্যানেজ করার প্রসেস চালাচ্ছে প্রোমোটার। তাতেও মোটা টাকার খরচা। সে যাই হোক ফ্লাট বুকিং শুরু হয়ে গেলেই প্রোমোটার আপনাদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেবে। 

দু - চক্রবর্তীটাওতো বেগড়বাই করছে দেখছি। খেলার মাঠটা আর ফুটপাথের অংশ দখল করিয়ে মন্দির বানাতে দিলাম। পার্টির ছেলেদের কোন ঝামেলা করতে দিইনি। প্রচারের গুণে কদিনেই কালীমাতাটা বেশ জাগ্রতাও হয়েছেন দেখছি। প্রণামী পড়ছে থালা ভরে। বাড়তি আয়ের জন্য কালীর পাশে শনিকেও বসিয়েছে কদিন আগে। দেশে যত চুরি বাড়ছে, পাপ বাড়ছে তত ভক্তিও বাড়ছে। মন্দিরও বাড়ছে রাস্তাঘাটে। শনিবার হলেই পাপীদের ভিড়ে ভিড়াক্কার। কিন্তু আমারটা মেটাচ্ছেনা শালা বামনা। ওর ড্রাগি ছেলেটাকে থানায় ধরে এনে একটু চমকাচ্চোনা কেন। 

মৃ - এমএলএ-র আস্কারায় ওতো আবার নান্টু ঘোষের দিকে ঝুঁকেছে। 

দু - তাহলে তিনজনকে টপকিয়ে তোমাকে প্রমোশন দিলাম কেন। আমাকেও তো উঁচুতলাদের ম্যানেজ করতে হয়। কিছু একটা ব্যবস্থা কর শিগ্গির। এদিকে আবার এ বছর খরাও হলোনা, বন্যাও না। তাই ত্রাণও এলোনা। আমার কপাল দেখছি খুব খারাপ। চার তলার ছাদ ঢালাইটা এখনও বাকি। অবুঝ গিন্নী মার্সিডিজ গাড়ী কেনার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করছে। পাঁচ বছরের দু বছরতো কেটেই গেল। কবে হবে সব। পরের ভোটে যদি দলের টিকিট না পাই তাহলে তো সবই যাবে। শুনছি খুনে সন্যাসী নাকি টাকা ঢালছে উপর মহলে। বাকিগুলো আদায়ের ব্যবস্থা কর। তানাহলে তোমার কপালে লোধাশুলি থানা আছে - এই আমি বলে দিলাম। ওখানকার এসিতো এমএলের বাড়িতে এখন থেকেই মোটা খাম দিয়ে দালাল পাঠাচ্ছে। 

মৃ - লোধাশুলির কথা মুখে আনবেন না স্যার। বৌ বাচ্চা নিয়ে একেবারে মরে যাব। ওখানে খাবো কি। জঙ্গলের আদিবাসী পাতা কুড়ানীয়াদের কাছ থেকে আর কত আয় হবে। এদিকে গিন্নীর খাঁইও বাড়ছে দিন দিন। সুদখোর হাড়কেপ্পন বাপের মাটির বাড়ীতে জন্মে আমার এতবড়ো দোতলা বাড়ী পেয়েও তার সাধ মেটেনা। আজ এসি চাই তো কাল বিশ হাজারী শাড়ী। (ব্যাগ থেকে দুটো বোতল বার করে) এদুটো এখন রাখুন স্যার। চন্দনপুরের খুনের আসামীর বাপ পাঠিয়েছিল। ভাবলাম এই ইমপোর্টেড স্কচের কদর পঞ্চায়েত স্যারই বুঝবেন। আর সবতো দেখি দেশী পেলেই বর্তে যায়। 

দু - বেশ বেশ, খুব ভাল। আজ রাতে আবার তোমাদের এসি সাহেব আসবেন একটু ফুর্তিফার্তা করতে। ভাবছিলাম শহরে যাবো মালটাল আনতে। 

মৃ - সেকি স্যার, আমরা থাকতে থাকতে ......

দু - সে আমি জানি। সাহেবের মেমসাহেব খুব কড়া ধাতের মহিলা। সব সময় চোখে চোখে রাখেন। উনি ওনার বালিকাকালের এক দেবদাসের সাথে হঠাৎ করে যাচ্ছেন মায়াপুর, না তারাপীঠে তীর্থ করতে। সেই সুযেগে এসি সাহেব এখানকার সার্কিট হাউস বুক করেছেন থানা ইন্সপেকশন দেখিয়ে। হাবুলবাবুর মেসের মুটি রাঁধুনীটাকে হায়ার করেছি ওনাকে দেখভাল করার জন্য। উনি যা পান তাতেই খুশি। কোন ছুৎমার্গ নেই। একেবারে সদাশিব, শিবঠাকুরের মত। 

মৃ - ঠিক বলেছেন, সাহেব খুবই সজ্জন। সোজা সরল নির্বিবাদী মানুষ। ওদিকে আইনজ্ঞান প্রখর। ধর্ষণ মামলাটা কেমন সুন্দর ধামাচাপা দিয়েছিল বলুন। আমার গিন্নী ওকে দারুন ম্যানেজ করেছিল ডায়মন্ড হারবারের রিসোর্টে চাঁদ দেখাতে দেখাতে। 

দু - বড্ড ফেঁসে গিয়েছিলাম মাইরি। কি করে বুঝবো এমন গ্রাম্য এলেবেলে মহিলাটা মাননীয় মন্ত্রী মশাইয়ের শালী। একেবারে কামদুনি করে মেরে ফেলিনি এই রক্ষে। তোমার গিন্নীকে ধন্যবাদ জানাতে ওনাকে একদিন আমার প্রাইভেট বাগানবাড়িতে নিয়ে যাব ডিনার করাতে। 

মৃ - ধন্যবাদ স্যার। চলি এখন। 

দু - ঠিক আছে। আমার বালি খাদানের ছেলেগুলোকে একটু দেখো।

মৃ - সে আর বলতে হবে না স্যার। (প্রস্থান)

দু - গবা, ও গবা। গ্লাস বোতলগুলো তুলে নিয়ে যা। আর কে এক প্রফেসর এসেছে, পাঠা সে শালাকে। 


(পক্ককেশী এক বয়স্ক ভদ্রলোকের প্রবেশ)

প্রফেসর ব্যানার্জী - চিনতে পারিস? মানে চিনতে পারছেন? তোর, মানে আপনার পিতাঠাকুর আমার বাড়ীর মালি ছিলেন। আপনার বাবার অনুপস্থিতিতে আপনিও আমার বাড়ীতে পায়ের ধুলো দিতেন বাগানে জল দেবার জন্য। আপনি আমাদের বাড়ীর ছেলের মত হয়ে পান্তাভাত খেতেন। তারপর আপনি মালির কাজ ছেড়ে মাছের ব্যবসা.... 

দু - খুব হয়েছে,আর পুরানো ইতিহাস বর্ণনা করতে হবে না। আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না। সেসব পুরানা কাসুন্দি ফরগেট করুন। যে ধান্দায় এসেছেন সেটা ঝটপট বলে ফেলুন। অন্তত: দু ডজন মাল লাইন দিয়ে আছে। পারিনা আর এতো লোকের আবদার রাখতে। কে ডোবা বোজাবে, কে রাস্তায় দোকান মন্দির ভাটিখানা বসাবে, কার ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করতে হবে - এইভাবে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে আর পারিনা। উপরতলার নেতারা এসব বোঝেন না। তাঁরাতো বলে দিয়েই খালাস - জনগণের সেবা করো, তাদের পাশে থাকো, তাদের মুখে হাসি ফোটাও...আমাদের হয়েছে জ্বালা। নেহাত এমপি সাহেব পাঠিয়েছেন, তাই ঢুকতে দিয়েছি। চটপট বলে ফেলুন আপনার বক্তব্য। 

প্রঃ ব্যানার্জী - মানে, ঐ প্রিন্সিপালের প্রমোশনটা। 

দু - ইংরেজিতে লেখা আপনার দরখাস্তটা আমি নিজে পড়েছি। ইংরাজীতে আপনার কেমন দখলটা সেটা আমি নিজে আরও ভালো করে যাচাই করতে চাই। তারপর ভেবে দেখবো। কেননা আপনি ইংলিশ মিডিয়াম নন। এত কম যোগ্যতায় আপনি কি করে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নেবেন জানিনা। জানিনা কলেজের ছেলেমেয়েদের কি ভুলভাল শিক্ষা দেবেন আপনি। তার ওপরে আপনি ডাক্তারী ছেড়ে এ লাইনে এলেন কেন সেটাও একটা রহস্য। 

প্রঃ - আমি ডাক্তার নই স্যার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে রসায়নে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। 

দু - তাহলে নামের পাশে ড: লিখেছেন কেন দুনম্বরী করে? 

প্রঃ - ভুল হয়ে গেছে স্যার।

দু - এদিকে আবার আপনি তিন প্রফেসরের জুনিয়র। এই বিদ্যে নিয়ে ... এম পি সাহেব তো রেকমেন্ড করে দিয়েই খালাস। কত দিয়েছেন সুপারিশ লেখাতে? আচ্ছা আচ্ছা, - থাক সেসব খারাপ খারাপ কথা। যে যার এলেম মত খিঁচবে। আমি বলার কে? এখানে ত্রিশ লক্ষ লাগবে 

প্রঃ - একটু বেশী হয়ে যাচ্ছেনা?

দু- আরে মশাই, প্রিন্সিপাল কি ছাগল, না শুওর যে দরদস্তুর করছেন গরুহাটের ব্যাপারীদের মত? কোশ্চেন বিক্রী, ছাত্র ভর্তি করেতো দু বছরেই উঠে আসবে ইনভেস্টমেন্টের টাকা। কমে পারবোনা। পাঁচজনকে নিয়ে আমাদের চলতে হয়। অমুক নেতার শালা, তমুক মন্ত্রীর ভাইপো, ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারী, শিক্ষা বিভাগের অফিসার - বখরাদার কি একজন মশাই। এ ছাড়াতো কালীঘাটের জাগ্রতা জীবন্ত মা কালীর পুজোর খরচতো আছেই। কমে হবে না। 

প্রঃ - কবে আসব বলুন?

দু - কালকে এলেই ভালো। 

      (প্রফেসরের প্রস্থান। অফিসারের প্রবেশ। পেছনে পেছনে একজন পিওন একগাদা সরকারি ফাইল টেবিলে রেখে গেল)    


দু - এসো এসো এসডিও সাহেব। আমার অঞ্চলে কেমন আছো বল?

এসডিও - (প্রণাম করে) আপনার ছাতার তলায় ভালোই আছি স্যার। কতগুলো জরুরী ফাইল সই করাতে এসেছি স্যার। 

দু - সব ঠিক দেখে নিয়েছো তো? আমার পিএ বলছিল তোমার নোটে নাকি ভুলভাল ইংরাজী থাকছে। কোথায় নাকি জয়েন্টেড এর জায়গায় জয়েন্ড লিখছ, নিমুনিয়া শব্দের আগে অহেতুক একটা পি বসিয়ে দিচ্ছ - এই বিদ্যে নিয়ে তোমরা আইএএস, বিসিএস পাশ কর কি করে? 

এসডিও - কাজের চাপে মাঝে মাঝে এমন ভুল করে ফেলি স্যার। অপরাধ ক্ষমা করবেন। 

দু - ফাইলগুলো রেখে যাও। পরে দেখেশুনে সই করে দেব। সব। আমার লোকেরা তোমার সব প্রাপ্য দিচ্ছে তো নিয়ম আইন মত?

এসডিও – হ্যাঁ স্যার, সব ঠিক আছে। তবে পার্সেন্টেজটা একটু বাড়ালে ভালো হয়। গিন্নীকে নিয়ে একটু বিদেশ যাত্রার ইচ্ছে আছে। 

দু - ঠিক আছে, নতুন চরের বালিখাদান থেকে ট্রাক পিছু একশ তুমি এক্সট্রা পাবে। তবে এখনকার মত যেন মাখনের মত কাজ চলতে থাকে। 

এসডিও - থ্যাংক ইউ স্যার, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। 

                  (পায়ের ধুলো নিয়ে জিভে ঠেকিয়ে এসডিও সাহেবের প্রস্থান) 

              



মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ী

(সর্বপ্রিয়া টিভি দেখছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ)

সর্বপ্রিয়া - দেখলেতো, আমি কী বলেছিলাম? ওই বৌ’টাই খুনি। বরের বসকে নিয়ে হোটেলে যেত ফুর্তি করতে। স্বামী জেনে যাওয়ায় মদের মধ্যে বিষ মিশিয়ে ওকে খুন করেছে। ঐ বৌগুলোকে গুলি করে মারা উচিত। 

 মৃ - তুমি আবার সিরিয়ালের বৌ’টার মত আমাকেও খুন করো না যেন। 

সর্ব- তুমি যেন কি! কিচ্ছু মুখে আটকায় না। যত্ত আজগুবি অলুক্ষুণে কথা। 

মৃ - লাল পার্টির অজয় সামন্তের কথাই বোধ হয় ঠিক। সেদিন বক্তৃতায় বলছিল “শুধু টিভি সিনেমার নাটকে নয়, আজকাল এ’সব হচ্ছে ঘরে ঘরে। কাগজে আর ক’টা বেরোয়। স্বামীগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে টাকার ধান্দায়, আর উপোসী বৌগুলো বোল্ড রিলেশন করছে ফ্রেন্ডশিপ ক্লাবে। সমাজ সংসার সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। শুধু খাই খাই,শুধু টাকা আর ভোগের লালসা। একদিন সব ঘরে আগুন জ্বলবে।” লোকটা আমাদের পার্টির নামে যা তা বলে বটে, তবে তার কথাগুলোর ভেতর চিন্তার বিষয় আছে। 

সর্ব - তোমার আজ হলো কি? কি সব উল্টোপাল্টা বকছো বুদ্ধিজীবীদের মত! দার্শনিক হয়ে গেলে নাকি? 

মৃ -  আমার আজকাল কিছু ভালো লাগছেনা। মানুষ ভেতরে ভেতরে যেন ধিকি ধিকি করে জ্বলে উঠছে আগ্নেয়গিরির মত। যেকোন সময় অগ্নুৎপাত হয়ে দেশটাকে পুড়িয়ে দিতে পারে। ভীষণ ভয় হচ্ছে কাজকর্ম করতে। শুনলাম বুড়ো পুলিশ মন্ত্রীর ঘনিষ্ট অল্পবয়সী বান্ধবীর বাড়ী থেকে নাকি কেজি কেজি সোনা আর কোটি কোটি টাকা পেয়েছে পুলিশ!  

সর্ব - এত টাকা নিয়ে করবেটা কি? 

মৃ - সে আর বুঝছে কে? লাল পার্টির অজয় সামন্ত সেদিন বক্তৃতায় বলছিল, “সবাই একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তারা কি চাচ্ছে, কেন চাচ্ছে, কি করছে তারা নিজেরাই জানেনা। টাকাগুলো খরচই করতে পারবেনা সারা জীবনে। হয় সুইস ব্যাংকে পচবে, না হয় ছেলে মেয়েরা ড্রাগ মদ খেয়ে ওড়াবে।” নাও, টাকাগুলো তুলে রাখ আলমারিতে। আজ আদায়টা ভালো হয়েছে। 

সর্ব - শোন, তোমার ছেলের হাজার দশেক লাগবে কালকে। 

মৃ - কি ব্যাপার, একেবারে কালকেই? এত্ত টাকা!

সর্ব - তোমার কি ঘর সংসারের দিকে এতটুকু নজর নেই? কাল যে তোমার ছেলেটার জন্মদিন সেটা ভুলে গেলে!

মৃ - ওহো, তাইতো বটে। পায়েস টায়েস বানাও তাহলে। 

সর্ব - আজকাল ওসব পায়েস নাড়ুর চাল নেই। যত্ত গ্রাম্য কালচার। সমাজটা অনেক এগিয়ে গেছে। (চা বিস্কুট টেবিলে রাখলো সর্বপ্রিয়া)

মৃ - (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আমার মাও জন্মদিন করতো আমার। সে সব কথা মনে হলে বুকটা উদাস হয়ে যায়। শঙ্কর মাস্টারের বাড়ি থেকে এক পোয়া দুধ চেয়ে এনে ফ্যানা ভাতে খানিকটা গুড় আর ওই দুধ মাখিয়ে পায়েশ খাওয়াতো আমায়।মায়ের স্নেহমাখা সে অমৃত এখনও মুখে লেগে আছে। মাকেও তাড়ালাম, মাতৃসুখও হারালাম। এখন বড় আফসোস হয়। তা ছেলের একেবারে দশ লাগবে কেন?

সর্ব - ওরা সব বন্ধুবান্ধব মিলে শহরের হোটেলে পার্টি করবে। 

মৃ -  পাঁচই দিয়ে দাও। 

সর্ব - বলেছিলাম সে কথা। বলে ওতে নাকি শুধু উইস্কির বিলও মেটানো যাবে না। 

মৃ -তাবলে এত টাকা পাব কোথায়। এইতো মাইনে। 

সর্ব  - সেটাও বলেছিলাম। বললো বাবা নাকি লক্ষ লক্ষ টাকা কামায় বলে ওর বন্ধুরা বলাবলি করে। একটু ভদ্রভাবে পার্টি না দিলে ওর খুব দুর্নাম হবে। তোমারও  মান মর্য্যাদা থাকবেনা  .

মৃ - এটা অবশ্য ঠিক। মেয়েকে দেখছিনা কেন?

সর্ব - ওতো কালই দিঘা, না বকখালি কোথায় একটা গেছে উইকেন্ড কাটাতে। ওর কলেজের অনেক নেতা মন্ত্রী লাখপতি কোটিপতির ছেলেরা ওর বন্ধু হয়েছে কিনা। ওদেরই একজন ট্যুরটা স্পনসর করছে। 

মৃ - দেখো, আবার কোনও কেলেঙ্কারি ফেলেঙ্কারি না বাধায়। বড়ি টোরি  সাথে দিয়েছো তো। 

সর্ব - সেটা তুমি আমায় বলে দেবে? হোটেলে রিসোর্টে আশ্রমে তীর্থে পুরুষমানুষগুলো  গাঞ্জা মদের নেশায় কি রকম পাগল পাগল হয়ে যায় সেটা আমার চেয়ে কে বেশি জানে। হাড়ে হাড়ে বুঝেছি সব। 

মৃ - মহিলারাও যে কমতি যায়না সেটাও আমি শুধু হাড়ে হাড়ে নয়, একেবারে মজ্জায় মজ্জায় বুঝি। 

সর্ব - তুমি কি আমায় সন্দেহ কর নাকি?

মৃ - ছি ছি সর্ব, তুমি কি ঠাট্টা ইয়ার্কিও বোঝোনা?

                                 



দৃশ্য - মন্দির

(পূজারী ঘন্টা নেড়ে প্রদীপ নাড়িয়ে আরতি করছেন ভক্তরা হাত জোড় করে বসে। কয়েকজন কাঁসর ঘন্টা বাজাচ্ছে নেচে নেচে। আরতি শেষে পুরুতের হাত থেকে প্রসাদ নিয়ে ভক্তরা সব প্রণামী ঢুকিয়ে দিলো বাক্সের ফোকরে। তারপর সবাই একে একে বেরিয়ে গেলো মন্দির থেকে। প্রণামী নৈবেদ্য সব ব্যাগে পুরে পূজারী ঠাকুর বেরুতে যাবেন, এমন সময় দেখেন কে একজন যেন এক কোনায় বসে আছে চাদরমুড়ি দিয়ে।)

পূজারী - কে ওখানে? ওকি, মৃত্যুঞ্জয়, এভাবে বসে কেন? তোমার কী হয়েছে?

মৃ - আমায় বাঁচান ঠাকুরমশাই। আমি নরকে যেতে বসেছি। (কান্না)

পু: - বলি হয়েছেটা কী? এত উতলা কেন? এতবড় ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার হয়ে কার ভয়ে মেয়েদের মত কাঁদছো? (পূজারীর কানে কানে মৃত্যুঞ্জয় কিছু একটা বললো) এতো সাংঘাতিক ব্যাপার। মহাপাপ করেছে তোমার মেয়ে। পরিবারসহ তোমাদের সবার নরকগমন অবধারিত। আইবুড়ো মেয়ের এ পাপের ক্ষমা নেই। কয় মাস হলো?

মৃ - জানিনা ঠাকুরমশাই, আমায় উদ্ধার করুন। আমি ঈশ্বরভীরু মানুষ। প্রতি গুরুবারে আমার গিন্নী এসে একশো টাকার প্রণামী দিয়ে পুজো করে যায় এখানে। সৎসঙ্গে দীক্ষা নেবার পর নিরামিষ খাই। হাতের সব আঙুলে নয় গ্রহের নয়টি আংটি পরি। জীবনে কোনও পাপ করিনি। আমাদের মেয়ে মদ সিগারেট খেলেও দেব দ্বিজে খুব ভক্তি। শিবের ব্রত করে, শিবের মাথায় জল ঢালে তারকেশ্বরে গিয়ে। পুরীর মন্দিরেও যাই, দিঘার নতুন মন্দিরেও। তবু আমার এমন কেন শাস্তি হলো ঠাকুরমশাই? নরককে আমি বড্ড ভয় পাই। যাগযজ্ঞ যা করেই হোক আমাদের উদ্ধার করুন। 

পু: - সেতো অনেক খরচের ধাক্কা। প্রনামীই শুধু লাখখানেক লেগে যাবে। তার ওপর মায়ের স্বর্ণমুকুট, সোনার জিভ........

মৃ - এত্ত?

পু - এটাকি ছোটোখাটো ব্যাপার বাবা। আইবুড়ো মেয়ের ইয়ে। গোহত্যা বামুনহত্যার সমান পাপ। ফল, অনন্ত নরক। যে মামলায় যেমন খরচ। তোমার এত চিন্তা কিসের। পুলিশের চাকরী, ভালো মাইনে, ভালো উপরি - মায়ের আশীর্বাদে তোমারতো কোনও অভাব নেই। এতো আর পুলিশ, ডাক্তার,উকিলদের দিচ্ছো না, মা’কেই তো দিচ্ছ। দেখবে করুণাময়ী মা সব দুইগুণ ফিরিয়ে দেবেন। যাও, সামনের অমাবস্যার রাতে  চলে আসো সব অনুপান নিয়ে। ফর্দটা তোমার গিন্নীর হাতে পাঠিয়ে দেব। তোমার আর কি, একবার হাঁকিয়ে দেবে, আর দশকর্ম, মালী, স্যাকরা সব অনুপান পড়ি কি মরি করে সোজা হোমডেলিভারি করে দেবে এই মন্দিরের ঠিকানায়। আরে বাবা, এতো আর ঘুষ নয়, প্রণামী-প্রণামী। প্রণামী দেবে মাকে। তোমার ভয় ভীতি দানধ্যান দেখে ধন্য ধন্য করবে দেশবাসী। আবার দয়াময়ী মা তোমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে তার প্রেমিককে বশীকরণ করিয়ে। একই খরচে একসাথে পুরুত জ্যোতিষের দুজনের দুটো কাজ করিয়ে দেব আমি।

মৃ - কিন্তু কে ওর সর্বনাশটা করলো তাতো বলতে পারছে না আমার সোজা সরল মেয়েটা। বশীকরণ করবেন কাকে। ওর ছেলে বন্ধুতো গন্ডা গন্ডা।   

পু - সবকটাকে গ্রেপ্তার করে থানায় এনে পিটিয়ে দাও, বাপ বাপ বলে সব বলে দেবে পটাপট। সবই মায়ের ইচ্ছা বাবা। যাও, মন শুদ্ধ করে ব্যবস্থা করে ফেল। চিন্তা করোনা, আমিতো আছি, ভয় কিসের?



উকিলের চেম্বার

মৃত্যুঞ্জয় - ছেলেকে আমার জামিন করিয়ে আনুন উকিলবাবু। শালা সিবিআই পুলিশ ওকে খুব মারছে দিন রাত। আপনার পায়ে পড়ি উকিলবাবু। 

উকিল - সেকি, সেদিন জোর গলায় বললেন, আপনি প্রবল পুলিশ অফিসার, কাউকে পরোয়া করেননা, ডজন ডজন এসি, ডিসি, নেতা মন্ত্রীদের সাথে আপনার ওঠা বসা। সবার কীর্তিকলাপ ফাঁস করে দেবার এলেম আছে আপনার। সবাই আপনার হাতের মুঠোয়, এমন কি জজ সাহেবরাও নাকি .........আপনার পেয়ারের পার্টি মাস্তানরা লকাপ ঘেরাও করে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনছেনা কেন। 

মৃ - সবাই হাত ধুয়ে ফেলেছে স্যার। ঐ মিডিয়াই কাল হচ্ছে। সব ছবি তুলে বারে বারে টিভিতে দেখিয়ে লোকগুলোকে খেপিয়ে দিচ্ছে। সব রিপোর্টারদের সিডিশন আইনে গ্রেপ্তার করা উচিত। সকাল বিকাল ২৪ ঘন্টা মহা আনন্দে এমন কুৎসা রটাচ্ছে যে নেতা মন্ত্রীরাও সামাল দিয়ে কেলেঙ্কারীগুলো চেপে যেতে পারছেনা। সবাই এখন নিরপেক্ষ হয়ে গেছে। কথায় বলে কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরোলেই পাজি। যাদের কেচ্ছা কেলেঙ্কারী দুর্নীতি এতদিন চাপাচাপি দিয়ে এলাম তারা এখন বলে আইন আইনের পথে চলবে। তানাহলে নাকি ভোটের মুখে তাঁদের ভাবমূর্তি কেঁচে যাবে। এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। 

উকিল - কিন্তু আপনার ছেলে তার দুগুণ বয়সী মহিলাকে টার্গেট করতে গেল কেন? রাস্তাঘাটের আপনাদের আদুরে ছেলেরা কত্তো কম বয়সী সহজ শিকারদের ধরছে। আর তা আপনারা শুধু দেখছেন, আপনাদের নেতামন্ত্রীরাও আস্কারা দিচ্ছেন। 

মৃ - খুব ভুল হয়ে গেছে স্যার। 

উকিল - শ্লীলতাহানি করেছে করেছে ঠিক আছে। আজকাল এ রাজ্যে সব জলভাত। আগেও এসব হতো চুপিসাড়ে। শাস্ত্র পুরাণের গল্পগুজবের সাধু সন্ন্যাসী দেবদেবীরাও ছেড়ে কথা বলতেন না। সোশ্যাল মিডিয়ার খোলামেলা কুকুর বিড়ালদের মত ফিল্মি প্রেম দেখে এখন এসব রোগ একটু বেড়েছে মাত্র। তবে আজকাল ওসব নিয়ে কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায়না। বেশির ভাগ গুরুজনেরা ঘটনাগুলো চেপে যান লোকলজ্জার ভয়ে। মন্ত্রী আমলারাও। কিন্তু আপনার পুত্তুর  খুন করতে গেল কেন?

মৃ - ওর কোন দোষ ছিলনা স্যার। বদমাস মহিলাটা ওকে চিনে ফেলেছিল ঐ মধুচক্রের ঠেকে। 

উকিল - তাবলে একেবারে খুন! তাও আবার আইপিএসের বৌকে!

মৃ - আমার ছেলেটা বড্ডো সোজা সরল। তখন ও নরম্যাল ছিল না। সেদিন তার জন্মদিন ছিলতো। বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু বেশি নেশা করে ফেলেছিল। মাথার ঠিক ছিলনা। একটা কোন আইনের ফাঁক দেখিয়ে ওকে বের করে অনুন না স্যার। 

উকিল - এতো আর শুধু আইনের ফাঁকে হবেনা। অনেক খরচ আছে। আইন-টাইন সব নোটের ওপরেই লেখা থাকে। এখানে আবার সরকারী উকিলটা মৌলবাদী ধড়িবাজ। বামপন্থী। এক পয়সা খেতে চায়না। তবে আর সবের খাঁই অনেক। প্রথমেই দশ লক্ষ লেগে যাবে। 

মৃ - এতো কি করে দেব স্যার?আমি সামান্য নিচু তলার পুলিশ। সামান্য মাইনে। আর্তি যা রোজকার হয় তার বেশির ভাগটাই চলে যায় পর পর উঁচুতলার পেট ভরাতে। একটু কমেসমে করুন স্যার। 

উকিল - আপনি একজন দায়িত্ববান অভিজ্ঞ পুলিশ হয়ে কি সব উল্টাপাল্টা বকবক করছেন। আপনারা নিজেরাইতো চা-ওয়ালা, খোঁড়া রিক্সাওয়ালা, ট্রেনের ফেরিওয়ালা, এমন কি মন্দিরের সামনে বসা ভিখারিদের পর্যন্ত মাসকাবারী কমান না এক পয়সা। সব খবরই   পাই আমি। 

মৃ - বড্ডো ভুল করেছি এতদিন। আর করবো না ওসব পাপ। সহকর্মীদেরও সাবধান করে দেব। 

উকিল - আজ থেকে আমি বাল্মীকি হয়ে গেলাম বললে হয়?

মৃ - আমার কেসটা একটু সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করুন স্যার। এমএলএ মার্ডার কেসটায় সরকারি উকিল কি স্ট্রাটেজি নিচ্ছে সে খবর দেব। পরস্পর এভাবে না দেখলে আমরা বাঁচবো কি করে?

উকিল - ঠিক আছে আমার ফিস্টে না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু পুলিশ খরচ,নেতার খরচ, রিপোর্টারদের খরচ ........ আপনি লাখ পাঁচেক নিয়ে আসুন, জামিনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। 

মৃ - শুধু জামিনের জন্য........

উকিল - শুনুন, এটা আপনার স্টেট পুলিশের কেস নয়, কোর্টের এদেশের জেরে সিবিআই মামলা। দেখছেন না দলেরই সব বাঘা-বাঘা এক নম্বর দুই নম্বর নেতা মন্ত্রীরা মাসের পর মাস জেল খেটে খেটে শুখনো মড়াকাঠ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে বুঝুন মফস্বল থানার সেকেন্ড অফিসারের ছেলের কি দশা হবে। 

মৃ - বুঝছি উকিলবাবু, কেউ কারো নয়, সুযোগমতো সবাই সবাইকে চুষছে জোঁকের মত। নেতা মন্ত্রী, সিন্ডিকেট,  ক্লাব, গুন্ডা বদমাস, ছেলে বৌ - সব্বাই সব্বাই সমান কেউ কারো নয়। এতদিন আপনার বিপক্ষদের সব খবর দিয়ে সব খবর দিয়ে এসেছি। সুযোগ বুঝে আপনিও আমার বুকে 

উকিল - এমনকি আপনিও আপনার বসে নেই। 

মৃ - ঠিক আছে উকিলবাবু, আমি বিকালেই আসছি। 


                                     নার্সিং হোম 

ডাক্তার বোস - কি ব্যাপার বাঘা দারোগা? এদিকে কেন? 

মৃত্যুঞ্জয় - মানে একটু বিপদে পড়েছি। 

ড: - আবার কার বাঁধলেন?আগেকার বান্ধবীটা ভালো আছেতো? পাপীটা কে ছিল জানতে পেরেছেন কি? আপনি যে নন সেটা আমি জানি। কোনও এক পরোকীয়া রসিক আপনার হাতে তামাক খেয়ে আপনাকে ফাঁসিয়েছিল। 

মৃ - খুব বাঁচিয়েছেন ডাক্তারবাবু, বৌ জানতে পারলে হুলুস্থুলু কান্ড হয়ে যেত। এবার এসেছি আমার নিজের মেয়ের জন্য। 

ড: - আপনার - নি-জের মেয়ে!! এটাও মনে হচ্ছে পরকীয়া কেস। মিহিরবাবু, কুড়ি বয়স বছরের পুরানো সিমেন্স রিপোর্টের ফাইলগুলো খুঁজে অনুনতো। কতদিন হলো?

মৃ - চার মাস ডাক্তারবাবু। 

ড: -  চা-মাস! এতদিন কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন নাকি। চারমাস ধরে বাড়তে দিয়েছেন পাপটাকে! আশ্চর্য! এত পুরানো কেস আমি অপারেশন করতে পারবো না। আমার যন্ত্রপাতি তত আধুনিক নয়। কলকাতার কোন নার্সিং হোম থেকে মালটা খালাস করিয়ে নিয়ে আসুন। 


(মৃত্যুঞ্জয় ডাক্তারের কানে কানে কিছু বললো। ডাক্তার ইশারা করে নার্সকে বাইরে যেতে বললেন।)

মৃ - যত টাকা লাগে করে দিন স্যার। অচেনা জায়গায় যেতে সাহস হয়না। আমার এমন ভালো চাকরি, মানসম্মান সব ভেসে যাবে ডাক্তারবাবু। 

ড; - আজকালকার উদার খোলামেলা সমাজে এসবে মান সম্মান যায়না। বড় বড় অভিজাত ঘরে এমন পরকীয়া কাণ্ডতো জলভাত। সমাজ সরকার দ্বারা স্বীকৃত। এইতো সেদিন কলকাতার ভেসেক্টমি করা মস্ত বড় অফিসারের মাঝবয়সী গিন্নি বেড়াতে যাবার নাম করে খালাস করে গেল দশ লক্ষ দিয়ে। চার চারটে দামড়া দামড়া ছেলে, স্বামী-আত্মীয় কাকপক্ষী টেরই পেলোনা। হোটেলে ডিস্কোতে নেশার ঘোরে কি সম্ভ্রান্ত, কি হঠাৎ বাদশা হওয়া প্রোমোটার সিন্ডিকেটের বাড়ির উপোসী মহিলারা তাড়াহুড়ো করে আজকাল ভুলে যান প্রটেকশন নিতে। 

মৃ - ওদের কথা ছাড়ুন, এ ব্যাপারে আমাদের গাঁ-গঞ্জও  আধুনিক হয়ে গেছে। পুলিশ সব খবর রাখে। আমার মেয়ের ব্যাপারে লাখ দুই দিয়ে দেব। 

ড: - কি সব বলছেন আজেবাজে কথা। এটাকি ভাড়াটে উচ্ছেদ? প্রোমোটার টেবিলের তলায় পাতা আপনাদের বাঁ হাতে দু লক্ষ ধরিয়ে দিলো, আর অমনি জনসেবক মা মানুষের স্বেচ্ছাসেবীরা এসে ভাড়াটেকে টেনে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দশ মিনিটে অপারেশন শেষ করে ফেললো। আর আপনি বন্ধুক হাতে ওদের পাহারা দিতে থাকলেন দূরের গাছের আড়ালে। ডায়রিও নিলেননা নিঃসঙ্গ বুড়ি ভাড়াটের। আপনার মেয়ের শরীরে অনুপ্রবেশকারী অবাঞ্চিত দখলদারটাকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে ভালো মন্দ কিছু যদি হয়ে যায় তার হ্যাপা সামলাবে কে। থানা, পুলিশ, পাড়ার মাতব্বর, পার্টির সেচ্ছসেবীদের খরচ কত বেড়েছে জানেন? অবশ্য মায়ের কাছে মাসির গল্প আর কি বলব। 

মৃ - ঠিকঠাক বিবেচনা করে বলুন কত দেব। 

ড: - কেলেঙ্কারীটা জানাজানি হয়ে গেলে আপনার ভাবি বেহাই মশাই বিশ লক্ষ কাটমানি না নিয়ে  ঐ এঁটো মেয়েকে ঘরে ঢোকাবে ভেবেছেন?

মৃ - আপনি আমায় ব্ল্যাকমেল করছেন, ডাক্তারবাবু। 

ড: - সে আপনি বলতে পারেন বইকি। কিন্তু সেটাতো আপনাদের কাছ থেকেই শেখা। নেতা মন্ত্রী, সরকারি আমলাদের কালো টাকার গন্ধ পেলে আপনারা কি বেচারাদের ব্ল্যাকমেল করেননা? আর ন্যাকামো করবেননা, মেয়েকে উপোসী রেখে আট লাখ ক্যাশ নিয়ে পরশু আসুন রাত দুটোয়। এপেন্ডিক্স অপারেশনের একটা এস্টিমেট লিখে  দিচ্ছি কাছে রাখুন। কেউ জানতে চাইলে ওটা দেখাবেন। আর এই এন্টিবায়োটিকগুলো খাওয়াতে থাকুন নিয়ম করে। 

মৃ - ঠিক আছে ডাক্তারবাবু। হাতি এখন কাদায় পড়েছে। তবে ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে। 

ড: - আরে এসব কাজ গোপনে না করলে আমাদের নার্সিং হোমের ব্যবসাটাই লাটে উঠে যেত। এবার আসুন আপনি। (নার্স এসে ডাক্তারের হাতে একটা কাগজ দিয়ে গেল) আচ্ছা একটু বসুন। এই দেখুন বহু আগে করা আপনার সিমেন্স রিপোর্টের কপি। আপনার স্ত্রী আসল রিপোর্টটা ডেলিভারি নিয়ে গেছেন সই করে। আপনার সিমেন্স কাউন্ট জিরো অর্থাৎ  বিজ্ঞানমতে আপনার ছেলেমেয়ে আপনার ঔরসজাত হতেই পারে না। আপনার বান্ধবীর সন্তানটিও আপনার ছিল না। এতো আর আধ্যাত্বিক শাস্ত্রীয় গল্পগুজব নয় যে কবিতা ফাঁদলাম, আর মহাকাব্যের নায়করা টুপ টুপ ঝোরে পড়লো সতী রানীমাতাদের পেট থেকে। 

মৃ - কি বলছেন আপনি। আমার ছেলে মেয়ে আমার ঔরসে জন্মায়নি! আমি আপনার নামে মানহানির মামলা করবো। 

ড: - তার আগে আপনার সতীসাধ্বী গিন্নীর কাছে জেনে নিন কে আপনার ছেলেমেয়েদের বাবা। এখনতো দেখছি আপনার পরকীয়া বান্ধবীদের ক্ষেত্রেও কেউ আপনার হাতে তামাক খেয়ে গেছিল। মজা লুটলো অন্য লোক, আর  তাদের বাচ্চাদের আপনি নিজের বাচ্চা ভেবে আমাদের অপারেশন ফি মেটালেন ওদের খালাস করাতে। 

মৃ - আমি এখন আসি ডাক্তারবাবু। (প্রস্থানোদ্যত)

ড: - আরে, বসুন। বসুন মশাই। এত উতলা হবার কিছু নেই। এই ডাক্তারী লাইনে এসে আমরা সব  দার্শনিক হয়ে গিয়েছি। প্রকৃতির নিয়ম যত কঠোরই হোকনা কেন তা মেনে নিতে শিখেছি। সত্যেরে নিন সহজে। এত ভাবাবেগ সেন্টিমেন্ট নিয়ে বেঁচে থাকা যায়না। কেউ সত্যি সত্যি  সতী নয়, আপনিও নন, আপনার গিন্নিও নন। অন্যান্য সুখী মানুষদের মত জীবনটাকে উপভোগ করুন - গিন্নি গিন্নির মত, আপনি আপনার মত। মনোবিজ্ঞানের পাঠ্য বই ‘আই আম ওকে, ইউ আর ওকে’ বইটা পড়ে নিন। আপনিও মধুমতীর সাথে দেখা করুন, আপনার স্ত্রীও ডায়মন্ড হারবারে ট্যুর করুক। মাননীয় আদালত বলেছেন পরকীয়া ফস্টিনস্টি সবার সাংবিধানিক অধিকার। সব গ্লানি মুছে ফেলুন। ‘স্ত্রী’ ছবির উত্তমকুমারের মত মিথ্যা আবেগের বশে কোনও কেলেঙ্কারী করে বসবেন না যেন। উইশ ইউ গুড লাক। মেয়েকে নিয়ে চলে আসুন যেমনটি বললাম। 


                          -আশারাম বাবার আশ্রম-

(ধ্যানে বসেছেন গুরুবাবা। ধর্মবাজারের গুরুবাবাদের মতই চোখ ঢুলুঢুলু- হাফবন্দ পদ্মলোচন। মুখমণ্ডলে প্রশান্তির ভাব। সর্বপ্রিয়া সামনে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রবেশ। সর্বপ্রিয়ার দিকে রিভলভার তাকে করে) 

মৃ - বল, বল ডাইনি, কে, কে আমার ছেলেমেয়েদের বাপ। 

সর্ব: বলছি বলছি, সব যখন জেনে গেছ, সব বলছি, রিভলভারটা নামাও। এই গুরুবাবা আর তার ছেলে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের নাম করে রাতের পর রাত আমার ওপর অত্যাচার করেছে। বাপ ব্যাটাদের কোন একজন আমাদের মোহিনীর বাবা। (মৃত্যুঞ্জয় আশারামের মাথা লক্ষ করে গুলি করলো। গুলির শব্দ শুনে গুরুবাবার ছেলে সত্যানন্দ ব্রহ্মচারী ছুটে আসতে ওকেও গুলি করলো। তারপর সর্বপ্রিয়ার দিকে রিভলবার তাকে করে)

মৃ - এবার বল কে আমার ছেলের বাবা। 

সর্বজয়া - বলছিগো, বলছি, বন্দুক নামাও। তোমার এসি সাহেব ...........

ম্রি - তাহলে মর তুই (সর্বপ্রিয়ার মাথায় গুলি)




সার্কিট হাউস

মৃত্যুঞ্জয় - (জানালার দিকে হাত উঁচিয়ে রিভলবার তাকে করে) বল শালা বড়কর্তা, কে আমার ছেলের বাপ। বল, বল, বল শালা বড় কুত্তা। 

এসি - (ঘরের ভেতর থেকে) কি সামান্য একটা থানা অফিসার হয়ে এসির  প্রাইভেট বেডরুমে উঁকি! তোকে আমি ক্লোজ করবো। 

মৃ - তার আগে তোর হৃৎপিন্ডটাকেই আমি চিরতরে ক্লোজ করে দেব লম্পট। কাল সকালে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে তোর ঐ উলঙ্গ চেহারাটা দেখাবে দেশবাসীকে, তারপর পোস্ট মর্টেম করবে মৃত ডিকম্পোজড সমাজটার। (গুলি, দর্শকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে) সবার খেল খতম, এবার তোমার পালা মৃত্যুঞ্জয় ...শেষ বুলেটটা তোমারি জন্য (মাথায় গুলি)


                               যবনিকা পতন 

(হল থেকে বেরুতে বেরুতে পাশাপাশি বাড়ীর জানালা থেকে দর্শকরা টিভির সংবাদ শুনতে পাবেন) এই  হলো প্ল্যানেট, আপনারা দেখছেন প্ল্যানেট আনন্দ। আনন্দে থাকে, আনন্দে রাখে। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হল, হরিহরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান দুর্যোধন নস্কর খুন। ভেড়ি ও চোলাই কারখানার দখল নিয়ে একই দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে এই খুন বলে স্থানীয় মানুষের সন্দেহ। সেটা মানতে রাজি নন বিধায়ক মানিক মন্ডল ওরফে গলাকাটা মন্টু। তার মতে পারিবারিক বিবাদের জেরেই এই খুন। অভিযুক্ত নান্টু ঘোষের বাড়ি জ্বালিয়ে দিলো উত্তেজিত গ্রামবাসী। নান্টু ও তার দলবল বেপাত্তা। তদন্ত চলছে। * মন্ত্রীপত্নী ধর্ষণ ও খুনের দায়ে অভিযুক্ত পুলিশপুত্র গ্রেপ্তার। চোলাই দোকানের মালিক খুনে অভিযুক্ত গুন্ডা বশীর আহমেদ সহ বারোজন আসামির বেকসুর খালাস। নিয়মমতো তদন্ত ও সাক্ষপ্রমান না দেবার জন্য পুলিশকে বিচারকের  ভর্ৎসনা। সিবিআই তদন্তের দাবী মৃতের আত্মীয়ের। * উচ্চপদস্থ  আমলার ৪৭ বছর বয়সী গৃহবধূর মেদিনীপুরের গরপাড় গ্রামের ‘নিষ্কৃতি নার্সিং হোমে’ গর্ভপাত করাতে গিয়ে প্রাণ দিলেন। নার্সিং হোম ভাঙচুর, ডাক্তার প্রহৃত। * এইমাত্র এক চাঞ্চল্যকর আত্মহত্যা ও সিরিয়াল হত্যার খবর পাওয়া গেলো। ঝাড়বুনি থানার সেকেন্ড অফিসার মৃত্যুঞ্জয়  মন্ডল একে একে তাঁর স্ত্রী, পারিবারিক গুরুদেব, গুরুপুত্র এবং তাঁর এসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে গুলি করে নিজে আত্মঘাতী। মৃত্যুঞ্জয়ের অবিবাহিত কন্যার জলে ডুবে মৃত্যু। সন্দেহ মেয়েটি অন্তঃস্বত্বা ছিল। পরিবারটি প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য নাবালক দেবপ্রিয় গৃহবধূ ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে ফাঁসিকাঠে ঝোলার অপেক্ষায় হাজতে। মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ীর মেঝে খুঁড়ে কোটি টাকার গহনা ও টাকা উদ্ধার। * পাটনার স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে প্রধান শিক্ষক ও দারোয়ানের গণ ধর্ষণ। * হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লোন নিয়ে বিদেশপাড়ি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীশ্যালকের।* অধ্যক্ষ নিয়োগকে কেন্দ্র করে অধ্যাপক ও ছাত্রনেতা খুন হলেন নিজের কলেজে। দেশ ও রাজ্যবাপী এমন গণঅপরাধ দেখে নেতা মন্ত্রী সমাজবিজ্ঞানী সাহিত্যিক সব শ্ৰেণীৰ বিদ্বজনেরা উদ্বিগ্ন। কুসংস্কারের প্রসার ঘটিয়ে সরকারী খরচে অযোধ্যায় রামমন্দির, দিঘায় বেআইনী জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের নিন্দা করলেন যুক্তিবাদী সমিতি। চাকুরীচোরদের হারানো চোরাই চাকুরী ও বাজেয়াপ্ত করা চাকুরীবিক্রয়ের চোরাই টাকা চোরদের ফেরতের আবেদন করলেন দয়ালু মন্ত্রী। দেশের একটি রাজনৈতিক দলকে সারা বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ ডাকাতদল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউ এন ও। এখন ছোট্ট একটা বিরতি। শীঘ্র ফিরে আসছি আরও খুন চুরি ডাকাতি ধর্ষণের আরও উত্তেজক খবরের ডালি সাজিয়ে। কোত্থাও যাবেননা। আমরাই আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য সব সময় প্রথম খবর দিয়ে থাকি। আনন্দসংবাদ নিবেদন করলেন, বঙ্গীয় জনতা পার্টি। আগামী নির্বাচনে বজপাকে ভোট দিয়ে দুর্নীতি করার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করুন  .........


এক রসসাহিত্যিকের অলৌকিক নরকযাত্রা -
অশোক দাস চার্বাক
May 19, 2025 | গল্প | views:7 | likes:0 | share: 0 | comments:0

চার্বাক চলে গেলেন। আমি ওনাকে তিক্তবাবু বলেই ডাকতাম। মাঝে মাঝে তেতোবাবু। আবার কেউ ডাকতেন ঝাঁজবাবু, কেউ ডাকতেন ঝালবাবু, কেউবা  বাঁকাবিহারী, বঙ্কিমবাবু - এমনি সব, মানে শ্রীকৃষ্ণের  মত তাঁর মধুমাখা অষ্টোত্তর শতনাম আরকি। টক-ঝাল কষা-নোনতা  শতরসের ককটেলে সম্পৃক্ত সদাহাস্যময় সদাকৌতুকপ্রবন রসসাহিত্যিক রসরাজ আমাদের অলরাউন্ডার চার্বাক মহারাজ। আমার রঙ্গব্যঙ্গ পত্রিকার  সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় লেখক।  

                

  মৃত্যুপূর্বকালে সজ্ঞানে তাঁর নিজেরই ড্রাফ্ট করা তাঁর অকাল স্বর্গ /নরকপ্রাপ্তির ‘আনন্দময়’ শোকের বিজ্ঞাপনটি পড়ে সকালের চা’টা তেতো হয়ে গেল। ‘চার্বাক’ কলম নামে তাঁর লেখা রম্যরচনা ও স্যাটায়ারগুলি কটুস্বাদের হলেও বেশ পাঠকপ্রিয় ছিল। আধুনিক পাঠকেরা কটুতিক্তরসাদি পছন্দ করে ও যে সব নেতারা সভা সমিতিতে অসভ্য খিস্তি খেউড় করে তাদের বীরের সম্মান দিয়ে ভোট দেয় বলে ওনার বিশ্বাস ছিল। এজন্য নাকি আধুনিক এসেম্বলি পার্লামেন্টে অসৎ অশিক্ষিত অসভ্য নেতারই প্রাবল্য। 

                   পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তেই থাকুন না কেন, মনে কোন নতুন রসের উদয় হলেই  ই-মেল করতেন তাঁর নিজস্ব ঘরানার রসসাহিত্য। উনি যোগ দেবার পর আমার পত্রিকার কাটতি দুগুনের বেশী হয়ে গেছিল। তবে তাঁর  উগ্র নাস্তিকতা বড্ড উৎকটভাবে প্রকট হতো তাঁর রঙ্গব্যাঙ্গে। সেগুলো ধর্মভীরু দুর্বল পাঠকদের ধর্মাভ্যাসের আবেগে আঘাত করত প্রবলভাবে। বিরুদ্ধ সমালোচনার জবাবে “ধর্মীয় আবেগে আঘাত দেওয়া একজন মানবপ্রেমী সমাজসেবী সাধুপুরুষের সামাজিক কর্তব্য” বলে উটকো উল্টাপাল্টা বাজে তক্ক শুরু করে দিতেন। এ মহান কর্তব্য না করলে নাকি মানুষের মধ্যে কৌতূহল জন্মায় না, মানুষ প্রশ্ন করতে শেখে না। তারা কেবল বাপ ঠাকুরদাদের তামাদী হওয়া অভ্যাস বিনা প্রশ্নে তামিল করেন মাত্র।” বলতেন, “বুদ্ধ, যীশু, সক্রেটিস, মহম্মদ, নিমাই, রামমোহন, বিদ্যাসাগররা যদি তাঁদের সমসাময়িক যুগের আধমরা ভীতু মানুষদের আবেগ অভ্যাসে আঘাত না দিতেন, তাহলে এখনও সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরপাক খেত, সতী পুড়তো, বাল্যবিধবারা কাশীর রঙিন পল্লীতে নাচতে নাচতে পচতো, গরুর দুধে সোনা ফলত, পাথরের গণেশ ঢক-ঢক করে দুধ খেত, ঈশপের গল্পের শুক সারিরা কৃষ্ণনাম গাইত, পাপীরা তাদের দেহ মন থেকে পাপ ধুয়ে ফেলার জন্য সাগরজলে ডুব দিতো, নিচুজাত বিদ্বেষী বেলুড় মঠে নাকি শুধু ব্রাহ্মণকন্যাই  কুমারীপূজার জন্য মনোনীত হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও বলতেন, “এখনও হয়ত আমরা আমাদের আদি গুরুজনদের অনুসরণ অনুকরণ করে উলঙ্গ থাকতাম অন্যান্য জীবজন্তুভাইদের মত। বলতেন, “ধর্মীয় আবেগে আঘাতের বিরুদ্ধে যে অসাংবিধানিক আইন আছে সেটি বাতিল করা উচিত।”এই ছিল তাঁর ফিলোজফি, এমনি তাঁর বাঁকা বাঁকা আজব আজব বোকা বোকা কথা। লেখার ভাষাটাও ছিল গ্রাম্যতাদোষে দুষ্ট। রাস্তাঘাটের নাটুকে নেতা-মন্ত্রী, লুম্পেন-মাস্তানদের বক্তৃতার মতো খিস্তি খেউড়ে ভরা। তবে মাঠভরা শিস  মারা হাততালি দেওয়া ভাড়াটে শ্রোতা ও গ্রাম্য ভোটারদের মত, কিংবা বোকাবাক্সের টিভি সিরিয়াল বা ঝগড়াঝাটির দর্শক শ্রোতাদের মত আমার পাঠকেরাও সে অশ্লীলতা অসভ্যতা খেত ভালো।  আর ওনাদের বিপুল ভোটে আমার পত্রিকা জিতে গিয়ে কাটতি বাড়াতো। এমনি চরিত্র ছিল চার্বাকের। তবে যে গরু দুধ দেয়, আর যে লেখক পাঠকসংখ্যা বাড়ায় তাদের খুরের লাথি একটু আধটু সহ্য করতে হয়। তাই তাঁর সব কুযুক্তি আমি মুখ বুজে সহ্য করতাম। 

             যাক, উনি এখন গত হয়েছেন, মৃত মানুষের নামে নিন্দামন্দ করা পাপ, তাই ওনার চরিত্র সম্বন্ধে নীরব থাকাই শ্রেয়।     

              বিজ্ঞাপনে  জানা গেল একাধিক দেশে রেজিষ্ট্রিকৃত তাঁর অন্তিম উইল অনুযায়ী কিডনি, লিভার চোখ ইত্যাদিসহ সমস্ত পুনর্ব্যবহার ও প্রতিস্থাপনযোগ্য কলাগুলি তাঁর মৃতদেহ থেকে কেটে বার করে নেবার পর তাঁর  দেহটি আজ বিকাল চারটায় হাসপাতাল থেকে তাঁর মেট্রোপলিটনের ‘কস্মোপলিটন হাউসে’ নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে মাত্র দু-এক ঘন্টার জন্য শায়িত থাকবে যাতে করে তাঁর গুনগ্রাহী ও পরিচিতজনেরা তাঁর অবশিষ্ট মরদেহটিকে শেষ দেখা দেখতে পারেন। নানা দেশমহাদেশের নাগরিক ও অধিবাসী তাঁর ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী  আত্মীয় পরিজনদের জন্য অপেক্ষা না করে তাঁর  কলামুক্ত  সে দেহটিকে নিয়ে যাওয়া হবে মেডিকেল কলেজে। সেখানে ছাত্র ছাত্রীরা দেহটা চিরে চিরে হাতেকলমে এনাটমি ফিজিওলজি শিখবে।  শেষ পর্যায়ে তাঁর অবশিষ্ট দেহাংশটা পচামাংসভুক পশুপ্রাণীদের বিলিয়ে দেওয়া হবে খন্ড খন্ড করে। এটাই তাঁর অশাস্ত্রীয় অন্তিম বাসনা।  হাতে উল্কি করে এই মর্মে বিজ্ঞাপনও করা আছে যাতে মরণান্তে তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা তাঁর ইচ্ছাপূরণে কোনও আইনী বাগড়া না দিতে পারে।  

           আমার পত্রিকার সামনের মাসের সংখ্যাটার ছাপা শেষ।  শুধু মলাট আর স্টিচিংটাই বাকি। বেশ গুছিয়ে একটা মর্মর্স্পর্শী শোকবার্তা ড্রাফট করে তেতোবাবুর  একটা ছবিসহ মেল করে দিলাম প্রেসে।  বলে দিলাম ফাঁকা তৃতীয় মলাটপাতায় ওটা ছাপাতে, আর পাঁচশ কপি এক্সট্রা ছাপাতে। শ্রাদ্ধের আনন্দভোজে, অভাবে স্মরণসভার জমায়েতে বিক্রি হয়ে যাবে ওগুলো। পেটভরা পেটুকরা ঢেকুর দিতে দিতে পান মুখশুদ্ধি চেবাতে চেবাতে আমাদের পত্রিকার কপি কিনতে বাধ্য হবে চক্ষুলজ্জার খাতিরে।    

            এরপর বন্ধুবান্ধবদের শেয়ার করার অনুরোধ জানিয়ে শোকবার্তাটা পোস্ট করে দিলাম ফেসবুকে। এক ঘন্টার মধ্যে চুয়াল্লিশটা লাইক, বাইশটা অশ্রু গড়ানো মুখ ভ্যাটকানো ইমোজি, তিরিশটি মন্তব্য আর একুশটা শেয়ার! ভাগ্য একটা করেছিলেন বটে! অকালে হলেও তাঁর মরণ স্বার্থক। স্বার্থক তাঁর  চির  আকাঙ্খিত আদর্শ মরণ। ঈশ্বরকে সত্বর কাছে পাওয়ার মহানন্দ। কোন একজন ঈশ্বরের কাছে তাঁর অশান্ত আত্মার শান্তি কামনা করে নিয়মমাফিক বিজ্ঞাপনও দিতে হবেনা পয়সা খরচ করে। 

             সৌজন্য রক্ষার খাতিরে সমবেদনা জানানোর জন্য চার্বাকগিন্নীকে  ফোন করলাম।  ধরলেন না। সারা জীবন যতই ঝগড়াঝাটি ফাটাফাটি চুলোচুলি করুননা কেন, স্বামীহারা হয়ে খুব সম্ভব শোকে কিংবা হয়ত হঠাৎ স্বাধীন হবার  আনন্দে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন ভদ্রমহিলা। এ সময়ে ওনাকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না। আমি যে ভদ্রতা করে ফোন করেছিলাম সেটা মিসডকল লিস্ট থেকেই জেনে যাবেন। সেটাই যথেষ্ট। জানতে পারবেন আমি তাঁকে কতোই না ভালোবাসতাম। এই মওকায় লেখকের বাকি মানুস্ক্রিপ্টগুলো বিনা রয়ালটি দিয়ে হাতিয়ে নেব ওনার কাছ থেকে। 


             চার্বাকভবনে যাবার পথে লেক মার্কেট থেকে একটা মড়া সাজানো সাদা ফুলের টায়ার ডিজাইনের তোড়া কিনে নিলাম শববাহী গাড়ির গায়ে ঝুলিয়ে দেবার জন্য। তা না হলে আবার কথা উঠবে সমাজের বাজারে। সে বাজারে টিকে থাকার জন্য নেতা, মন্ত্রী, জ্যোতিষ, সেলসম্যান, গুরুবাবা, পত্রিকা সম্পাদকদের কত রকমের নাটক যে করতে হয়! একটা সুদৃশ্য কার্ডে আমাদের পত্রিকার নাম ফুলের তোড়ায় সাঁটিয়ে দেব সেলোটেপ দিয়ে। সামান্য খরচে ভালো একটা বিজ্ঞাপন হয়ে যাবে ফাঁকতালে।  


                 বাইপাসের মোড় থেকেই ভিড় শুরু। সবাই সাদা ফুলের তোড়া হাতে ছুটছে লেখকের কসমোপলিটান হাউসের দিকে।  রাস্তার দু পাশের কোথাও পার্কিংয়ের জায়গা পেলামনা।  দূরের একটা গলিতে কোনরকমে গাড়িটা পার্ক করিয়ে হাঁটতে থাকলাম মাথা নিচু করে, মুখ ভারভার ভাব দেখিয়ে। রাস্তার দু পাশে হাঁটতে থাকা পথিকদের বেশির ভাগের হাতে সাদা ফুলের তোড়া। তিনি যে এতো জনপ্রিয় ছিলেন  তা জানতাম না আগে। হয়ত সাহিত্যিক নিজেও জানতেন না। জীবিতাবস্থায় এসব দেখে যেতে পারলে তাঁর আত্মা এই পৃথিবীতেই সজ্ঞানে সশরীরে শান্ত হতো। আত্মার শান্তির জন্য মরার পর আত্মীয়দের দেওয়া বিজ্ঞাপনের জন্য অথবা ঘটা করে শ্রাদ্ধ শান্তির নাট্যাভিনয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না। 

                 সাহিত্যিকের বাড়ীর পেল্লাই লোহার গেটের পাল্লাদুটোর একটা বন্ধ।  অন্যটাকে সিকিউরিটি আগলিয়ে রেখেছে। সিলেক্টেড দর্শনার্থীকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। সামনের রাস্তায় সবাই ফুল হাতে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। মাথা নিচু করে। এক পাশে ‘স্বর্গরথ’ নামাঙ্কিত একটা শববাহী গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত চার্বাকের দেহটিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বাড়ির ভেতরে। শববাহী যানটির পেছনে নিউজ চ্যানেলের দুটি ভ্যান পার্ক করা আছে। ফটোগ্রাফাররা ঢাউস ঢাউস ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে ছবি তুলছে রাস্তার জনসমাবেশের। ভাষ্যকারেরা মাইক হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লেখকের গুণগ্রাহীদের প্রতিক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার করছেন।  অনুমতি পেলে শবদেহের ছবি তুলতে ঘরের ভেতরে ঢুকবেন তাঁরা। 

                  দোতলার হলঘরটায় একটা ডিভানে পাতা এম্বুলেন্সের স্ট্রেচারে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন চার্বাক। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা। বুকে তাঁর ফুলের পাহাড়।  মহিলা পুরুষ, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ বৃদ্ধায় ঘর ঠাসা।  সবার মুখ গম্ভীর, চোখে  কাঁদো কাঁদো অভিব্যক্তি। এতো ভীড়, কিন্তু প্রায় শব্দহীন ঘর। শান্ত গুরুগম্ভীর শোকস্তব্ধ পরিবেশে শুধু টিভির সাংবাদিকরা ধীরে ধীরে গলা উঠিয়ে নাবিয়ে, থেমে থেমে ধরা ধরা কাঁপা কাঁপা গলায় সুর পাল্টাতে পাল্টাতে ধারাভাষ্য দিচ্ছেন তাঁদের চ্যানেলের দর্শক শ্রোতাদের শোনানোর জন্য। 

                  তাঁদের প্রশ্নের জবাবে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে সামান্য একটু বাড়াবাড়ি করেই বললাম, “সঞ্জীববাবু ব্যাঙ্গ সাহিত্যের জগৎ থেকে অবসর নিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করার পর বঙ্গের ব্যঙ্গ সাহিত্য সাম্রাজ্যে এই চার্বাকই ছিলেন বর্তমান প্রজন্মের একছত্র অধিপতি। সেই নক্ষত্রপতনে বঙ্গীয় রসসাহিত্য জগৎ অনাথ হয়ে গেল। আর কিছু সত্যি মিথ্যে প্রশংসার কথা মনে মনে খসড়া করার সময় বিশ্বনিন্দুক জয়দেববাবু মুখ বাড়িয়ে দিলেন ক্যামেরার দিকে। তাঁর পত্রিকায় তিনি  নিয়মিত  মুখর হতেন চার্বাক নিন্দায়। কিন্তু আজ ঐ সাহিত্যিকের জনপ্রিয়তা দেখে সে পথে না গিয়ে ওনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললেন, “ওনার মত গুণবান লেখক দুর্লভ। এমন কি আমার চেয়েও ভালো লিখতেন তিনি.....” ঘুরপথের অশ্লীল আত্মপ্রশংসা শুনে টিভির ভাষ্যকার মাইকটা ওনার মুখ থেকে সরিয়ে নিতে তিনি একটু ঘাবড়ে গিয়ে মাউথপিসটা ভাষ্যকারের হাত থেকে নিজের মুখের সামনে টেনে নিয়ে বললেন, “তাঁর কৌতুকগুলি বিতর্কিত, বিরক্তিকর ও অসহ্য হলেও অনেকের কাছে সুখপাঠ্য ছিল।” পাশ থেকে একজন মুখ বাড়িয়ে বলে উঠলেন, “ওনার কথা আর বলবেননা মশাই। উনি সদা সর্বদা রসেবসে বেয়াড়া রকমের টইটুম্বুর হয়ে থাকতেন। রঙরসের মাতাল। স্থান কাল পাত্র কোনও জ্ঞান থাকতোনা তাঁর কোনও রসের কথা মনে উদয় হলে। গুরুজন লঘুজন জ্ঞান নেই। পিকনিকেও যা আবার মন্ত্রীর গুরুগম্ভীর প্রশাসনিক বৈঠকেও তাই।রাস্তার সবজিওয়ালা, থেকে শুরু করে রাশভারী হেডমাস্টারমশাই,  এমন কি হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতিও  রেহাই পেতেননা তাঁর হাসি মস্করার কামড় থেকে।”

        আর একজনকে বলতে শুনলাম, “তবে বিপদেও পড়তেন তিনি তাঁর ঐ বদ স্বভাবের জন্য।  হয়ত কোন ঝগড়াটে সবজিওয়ালীকে বলে বসলেন, - তোমার মুখের মত ঝাল দেখে লঙ্কা দাওতো একশো। ব্যাস অমনি বাজারে লেগে গেল লংকাকান্ড। মহিলার মুখ তুলে কথা! বাজারের সব সবজিওয়ালা চেপে ধরলো ওনাকে। মার দিতে বাকি রাখল শুধু।”

                -আরে সবজিওয়ালী ফলওয়ালা তো দূরের কথা নিজের শালী এমনকি নিজের গিন্নীর সাথেও মাঝে মাঝে বোকার মত মুখ ফস্কে রসিকতা করে ফেলতেন এই রসিক চূড়ামণি। কী দুঃস্বাহস! সন্তানসম্ভবা মেয়ের পেটের মধ্যেকার যমজ নাতি  নাতনীর খেলাধুলার লাইভ ছবি সোনোগ্রাফিতে দেখার পর আনন্দে আটখানা হয়ে অফিস ফেরত কর্তার বেল শুনে তাঁর ঘরে ঢোকার আগেই রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে বলে উঠলেন “সুখবর, সুখবর, ডাবল সুখবর......” পরবর্তী বাক্যের অপেক্ষা না করেই ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তিনি চটজলদি বলে উঠলেন, “কেন, তোমারও নাকি?” ব্যাস, সাত ডিগ্ৰী স্কেলের ভুমিকম্প শুরু হয়ে গেল সংসারে।  সাহিত্যিক তখন সক্রেটিস। ঘরে না ঢুকে সোজা বেরিয়ে গেলেন পাড়ার চায়ের দোকানের সন্ধানে”

      এক মহিলা বলে উঠলেন, “ভদ্রলোক জীবিত থাকলে ওনার সম্বন্ধে এভাবে  কথা বলতে কি আপনাদের সাহস হতো?”

        উত্তরে আর এক বৃদ্ধা মন্তব্য করলেন, “বলা যায় না, ওনার যা স্বভাব চরিত্তির ছিল, হয়ত দেখলেন আপনাদের এ সব কথা শুনে ওনার আকাশমুখী ডেডবডিটা স্থান কাল পাত্র ভুলে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে রঙ্গব্যাঙে তুলোধুনো করে সব্বাইকে ঠান্ডা করে দিচ্ছেন।”

          লেখকের লেখার ঘরের টেবিলটায় রাখা হয়েছে তাঁর একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ। তাতে সবাই মালা পরিয়ে দিচ্চে।  পাশে রাখা ধূপদানীতে ধুপ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ছবিটা নাকি তাঁর এক নামকরা ফটোগ্রাফার বন্ধুকে দিয়ে তুলিয়ে নিজেই কাঁচ দিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন তাঁর শেষযাত্রার জমায়েত বা শ্রাদ্ধের আনন্দভোজের  অতিথিদের প্রদর্শনের জন্য। 

            পাশের ঘরের টেবিলে দুটো সুদৃশ্য চামড়ায় বাঁধানো একটা খাতা। মৃতের গুণমুগ্ধরা লাইন করে দাঁড়িয়ে একের পর এক শোকবার্তা লিখছেন। 

              মৃতের শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে নানা জনের ভালো মন্দ নানান  স্মৃতিচারণ ও মন্তব্য শুনছি। কিছু ফিসফিসিয়ে, কিছু সশব্দে।  

     - এত বড় লেখক হয়েও একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক। 

     - তবে উনি গোপনে গোপনে যে বেহেড মাতাল ছিলেন সেটা আমি নিজের চোখে দেখতাম রেসের মাঠে, আর বার-এ। উনি আমায় চিনতেই পারতেন না তখন নেশার ঘোরে।  

     - ফাঁক থেকে ওনার ধার করা আমার দশ হাজার টাকা চোট  হয়ে গেল।  এখনতো আর ওনার বিধবা স্ত্রীকে .....

      - সেকি, আপনার মত ওয়ান পাইস ফাদার মাদার বন্ধক ছাড়া এতগুলো টাকা .......... 

      - অত্যন্ত সজ্জন মানুষ ছিলেন। সুখেই বলুন কি দুখেই বলুন, সব সময় মুখে হাসি - মন রঙ্গরসে ভরপুর। ওঁর সাথে কথা বলে বড় সুখ ছিল। নিমেষে মনের দূঃখ ভুলিয়ে হাসিয়ে দিতেন। শত্রুদেরও বন্ধু করে নিতেন হাঁসতে হাঁসতে, হাসাতে হাসাতে। 

      - আমাদের সাথে তো ওনার একটা পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। আমার গিন্নীতো চার্বাক প্রেমে পরকীয়া অজ্ঞান। 

      - আমার সাথে দেখা হলেই বিড়ি চেয়ে নিতেন আপন বড় ভাইয়ের মত।   

      - তবে উনি যে সঞ্জীব চাটুর্জেকে নকল করতেন সেটা আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। ওনার লেখা রঙ্গরচনাই তার প্রমান। পোড়ে দেখবেন। 

      - তবে ওনার লেখাগুলো বাঁকা ভাষায় হলেও বেশ লাগতো পড়তে। মানে সুখপাঠ্য। 

      - থামুন মশাই, উনিতো সত্যজিৎ রায়কে নকল করে ডিটেক্টিভ উপন্যাস লিখে বেশ ভালোই কামিয়েছেন। 

      - তাই নাকি! ভেজালে ভেজালে দেশটা ভরে গেল দেখছি। 

      - অরে মশাই, ইনিতো সামান্য একজন লেখক। একটু আধটু এর ওর নকল করে, অপরের  লেখা সামান্য অদল বদল করে লেখকেরা যে দুনম্বরী সাহিত্যব্যবসা করেন এটা কে না জানে। এতে দোষের কিছু নেই।  

      - ঠিক বলেছেন। স্কুলের মাস্টার থেকে শুরু করে, স্কুল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে, পঞ্চায়েত সভাপতি থেকে শুরু করে, শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে, উনিভার্সিটির উপাচার্য থেকে শুরু করে নানান দেশের প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে কে যে একনম্বরী, আর কে যে চোরা পথে  চাকরি বাগিয়েছেন, কে যে কাল্পনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী বা জ্যোতিষীর স্বর্ণপদক কিনেছেন তা বোঝা দায়।  এখনতো আশপাশের সবাইকেই চোর পকেটমার মনে হয়। উঁচুস্তরের মাননীয় নেতানেত্রীদেরও  কান্ডকারখানা দেখলে মনে হয় সর্বকালের সর্ববৃহৎ সর্বশ্রেষ্ঠ ডাকাত দলের সর্দার। 

       - যা বলেছেন। বাসের গায়ে “পকেটমার হইতে সাবধান ---

      -ছোটবেলায় আমি বিখ্যাত বহুল প্রচারিত একটা সাপ্তাহিকে  ‘যষ্টিমধু’  বিভাগের পাতার  ওনার অনেক লেখা পড়ে ওনার ফ্যান হয়ে গেছিলাম। ঐ পত্রিকা ‘যষ্টিমধু’র পাতা  বন্ধ করার পর...........  

      - এমন নক্ষত্রপতনের পর আর এমন লেখা লিখবে কে? বাংলাদেশটা রসশুন্য হয়ে গেল। 

       - যা বলেছেন,  হাসির ক্লাবের হাসিগুলো যেমন আমাদের কাঁদায়, তেমনি রম্য রচনার নামে এখনকার ভাঁড়ামির গল্প পড়েও হেঁচকি ওঠে। 

         বিভিন্ন দেশবিদেশের ভক্তদের নাম ঠিকানা লাগানো ফুলের তোড়া, ধুপ, মড়ার পোশাকে দেবার জন্য সুগদ্ধি আসছে কুরিয়ার এজেন্ট মারফত। চারদিকে অগুরু অগুরু মড়া মড়া গন্ধ। বিভিন্ন দেশবিদেশে থেকে তাঁর ছেলেমেয়ে নাতি নাতনী আপনজনেদের পাঠানো ফুলমালায় আজকের নায়কের বুকে ফুলের পাহাড়। বড় নাতনী বিলেত থেকে অনলাইনে অর্ডার করে এক ক্রেট হুইস্কি পাঠিয়েছে ক্লান্ত শ্মশানবন্ধুদের  বিনোদনের  জন্য। স্মার্টফোনে আসা গাদা গাদা মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছার  মেসেজ দেখানো হচ্ছে ছাতে লাগনো বিগ স্ক্রিনে।  

          লেখকের বিখ্যাত মঞ্চাভিনেতা ভায়রাভাই উপস্থিত শোকগ্রস্থদের আপ্যায়ন  করছেন চোখ মুছতে মুছতে।  দিল্লিতে থাকা বর্তমান লেখকগিন্নী  বিকেলের ফ্লাইট ধরে ফিরে আসছেন চিত্তরঞ্জন পার্কের আজকের কবি সম্মেলনে তাঁর স্বরচিত কবিতাপাঠ না করেই। কী মহান আত্মত্যাগ! লেখকের একাধিক  প্রাক্তন প্রেমিকা আর আদিগিন্নীও এক কোনায় ছলোছলো নেত্রে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। একেই বলে বাঙালি রমণী। প্রেম কাকে বলে এরাই জানে। প্রেমভঙ্গ  বা ডিভোর্স হবার পরেও প্রেম অটুট। অবশ্য গিন্নীদেবীর প্রাক্তন স্বামীরাও এসেছেন তাঁদের প্রাক্তন স্ত্রীকে সান্তনা দেবার জন্য। 

         বারান্দা দিয়ে দেখা গেল বিখ্যাত এক ফাস্টফুড কোম্পানীর ভ্যান এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনের রাস্তায়। তারপর একটা ভ্যান বিখ্যাত এক মিঠাই কোম্পানির।  একটা আইসক্রিম কোম্পানির গাড়ীও।  উপচে পড়া ভিড় ঠেলে ওদের  কর্মচারীরা একে একে খাবারের প্যাকেট হুইস্কির বোতলগুলো নিয়ে সোজা তিন তোলার ছাতে  উঠে গেল। সাথে সাথে বোতল রসিকরাও মৌমাছির মত উড়ে গেল সিঁড়ি বেয়ে।  

            একটি ঘরে আত্মীয় স্বজনেরা শ্রাদ্ধের আমন্ত্রণপত্রের খসড়া তৈরি করছেন। ক্যাটারার নির্বাচন নিয়ে তক্কাতক্কিও চলছে। উপস্থিত আত্মীয়দের বাচ্ছাকাচ্চারা বড় বাড়ী পেয়ে লুকোচুরি খেলছে। একটা ঘরে আসন্ন শ্রাদ্ধভোজের মেনু তৈরি করছে কমবয়সী ছোকরারা। মৃদু ডেসিবেলে “আছে দুঃখ আছে মৃত্যু” বাজছে সাউন্ড সিস্টেমে।  সর্বত্র একটা শোক শোক,  উৎসব উৎসব, আনন্দ আনন্দ, দুঃখ-দুঃখ, টক-ঝাল- মিষ্টির পরস্পর বিরোধী এক সাড়ে বত্রিশভাজা স্বাদের পরিবেশ। 

              অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য ছাতে সাজানো হয়েছে নানা রকমের খাবার আলাদা আলাদা কাউন্টারে।  চা,কফি, সফ্ট ড্রিঙ্কস, হার্ড ড্রিঙ্কস। ভাইরাভাইয়ের বিনীত অনুরোধে যে যার পছন্দমত খাবার তুলে নিয়ে খাচ্ছেন, পান করে ঢলাঢলি করছেন। 

             ব্যাপারটা কি? এমন ভোজের কথা ভূ-ভারতে কখনও শুনিনি।  কল্পনাও করিনি। একজন মানুষ মারা গিয়েছেন, বাড়িতে তাঁর বাসি মরদেহ শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়, এখনও পর্যন্ত তার সৎকার পর্যন্ত  হয়নি - আর কিনা এত খাওয়া দাওয়া ফুর্তি ফারতা! আশ্চর্য! শ্রাদ্ধের দিনের জন্য কটাদিন অপেক্ষা না করেই এত  আনন্দফুর্তির আয়োজন! ছি ছি ছি। শত ছি। মানুষ বড় হৃদয়হীন হয়ে উঠছে দিনদিন। 


               আমার ক্ষোভের উত্তরে চার্বাকভায়রা ভাই বিনয়ে বিগলিত হয়ে সাফাই দিলেন যে তিনি তাঁর প্রয়াত ভায়েরাদাদার মৃত্যুপূর্ব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন মাত্র। তাঁর অতিথি দর্শনার্থীরা আনন্দভোজ ও চিয়ার্স মন্ত্র বলে আনন্দপান করে সন্তুষ্ট না হলে তাঁর দাদার আত্মা নাকি শান্তি পাবে না স্বর্গে কিংবা নরকে  যেখানেই থাকেন না কেন!   

                এতবড় ঘোর উগ্রনাস্তিকও তাহলে মরার সময় নরকভয়ে কাতর হন! মরণকালে এমন ভীমরতির কারণেই পৃথিবীর দিকে দিকে আজও টিকে আছে হাজার হাজার ধর্ম, হাজার হাজার ভগবান। উঠছে চন্দ্র সূর্য সময়মত। 

               ভাইরাভাইয়ের কথায়  উৎসাহিত হয়ে আর একটা প্যাকেট তুলে নিলাম টেবিল থাকে। মটন বিরিয়ানিটা করেছে ভাল। চার্বাক আত্মাকে শান্ত করার দায়িত্ব না এড়িয়ে আর একবার একটা গ্লাসও ভোরে নিলাম বড় করে।  

                এমন সময় সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের জীপ এসে দাঁড়ালো বাড়ীর সামনে। ভাইরাভাইটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন অফিসারের দিকে।  অফিসার বললেন যে তাঁর কাছে নাকি গোপন খবর আছে যে এটা  সুইসাইড কেস, স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। মার্ডারও হতে পারে। ডেথ সার্টিফিকেট, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ইত্যাদি না দেখে মৃতদেহটিকে শ্মশানে নিয়ে যেতে দেওয়া হবে না। একথা বলে মৃতের স্ত্রীকে ডাকতে আদেশ করলেন অফিসারটি। 

                   ভায়েরাটি সবিনয়ে হাত জোড় করে বললেন, “আগে একটু মিষ্টিমুখ করে নিন স্যার।  নইলে মৃতের পুন্যজীবনের অকল্যাণ হবে। আমি কথা দিচ্ছি আপনার নির্দেশ মেনে সব ডকুমেন্ট দেখিয়ে দেব ডেডবডি রিমুভ করার আগে।  

                  -ঠিক আছে, ডেডদেহটাতো দেখান অন্তত চাদরটা তুলে। 

                  - সেটাতে একটু অসুবিধা আছে। অঙ্গদানের কারণে দেহটা একটু বিকৃত হয়ে গেছে বলে তাঁর স্বামীঅন্তপ্রাণ  সদ্য বৈধব্যপ্রাপ্ত স্ত্রী অনুমান করছেন। উনি এয়ারপোর্ট থেকে এলেন বলে। তাঁর পৌঁছনোর আগে মৃতের আবরণ উন্মোচন করতে না করেছেন তাঁর শোকগ্রস্থ সহধর্মিনী। এটা স্যার একাধারে ধর্মীয়, অন্যদিকে প্রেমজ আবেগের ব্যাপার। জীবিত অবস্থায় বোমভোলা স্বামীকে পরিপাটি না সাজিয়ে বেরুতে দিতেন না তিনি। আজ তেমনি মৃত স্বামীটিকে না সাজিয়ে.........

                   - সব ঠিক আছে, কিন্তু ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে কি বাধা? 

                   মহিষাসুরের পার্ট করা তাগড়াই ধৈর্যহারা ভায়রাটি  তড়িঘড়ি স্ফীতোদর  পুলিশ সাহেবটিকে একরকম জোর করে টেনে নিয়ে  পাশের ঘরে ঢুকলেন এক আত্মীয়ের হাত  থেকে একটা মিষ্টির প্যাকেট, আর একটা খাম নিয়ে। খানিক বাদে মুখ মুছতে মুছতে খুব হাঃহাঃ করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন অফিসার। পুলিশ হলেও সদ্য মৃতের বাড়িতে এসে তাঁর মৃতদেহের সামনে কি করে একটা মানুষের এত হাসি আসে বুঝতে পারলাম না। তবে বুঝতে পারলাম বেশ বড় অংকের একটা গোপন লেনদেন হয়ে গেল।

                কিন্তু সুইসাইড! এমন সদাহাস্যময় সদানন্দ কৌতুকপ্রেমী সফল মানুষ সুইসাইড করেন কি করে! কিসের দুঃখ লুকিয়ে ছিল তাঁর হাসিমুখের অন্তরালে? বাহাত্তরেও এমন সতীসাধ্বী মা লক্ষী গিন্নী, সাত চড়ে রা নেই, এতো যার জনপ্রিয়তা, চার হাজার স্কোয়ার ফিটের বিলাসবহুল বাড়ী, মোটা টাকার সরকারী পেনশন, মোটা অংকের রয়্যালটি, দেশবিদেশে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ আয়ের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী, নানা দেশের নানা ধর্মের নাতজামাই নাতবউদের নিয়ে ভরা সুখী সংসার - এ রকম লোকের বুকে কি এমন কান্না লুকিয়ে ছিল যে একেবারে সুইসাইড করতে হল? ধন্য মানবের মন, ধন্য ত্রিভুবন।  বিচিত্র তাদের মনের প্রকৃতি তথা বিকৃতি! বাট্রান্ড রাসেল ঠিক কথাই বলেছেন। 

              মৃতের চারিদিকে ঘিরে অভিজাত ক্যাটারারের উপাদেয় প্লেট হাতে সবাই চার্বাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।  এমন কি চিরনিন্দুক সমালোচক, ব্যর্থ কবি সাহিত্যিকরাও চার্বাকের অপচিন্তা,অপকর্ম, অপদর্শন,অপকথন,অপসাহিত্যের কথা সৰাই ভুলে গেলেন। লাল জলের এমনি মহিমা। মুহূর্তে সবাই শোক দুঃখ ভুলে হাসি ঠাট্টায় মুখরিত। 

               অবিচুয়ারি লেখার জন্য টেবিলে রাখা দু’দুটো মোটা মোটা বাঁধানো খাতার সব পাতা শেষ। গদ্যে পদ্যে  শোকসাহিত্যের উথাল পাথাল কান্না। নানা ঘরানার প্রতিভার উজ্জ্বল সমাবেশ। 

               চার্বাকের প্রিয় আলসেশিয়ানটা নীরবে শুয়ে আছে তার প্রভুর ডিভানের গায়ে গা ঠেকিয়ে।  সারাদিন কিছু খায়নি।  এতো আর বুদ্ধিমান চতুর  হোমো স্যাপিয়েন নয়। অবলা এলেবেলে নির্বুদ্ধি পশুমাত্র। মাঝে মাঝে চোখ ঘুরিয়ে কাকে যেন খুঁজছে।  হয়ত ভাবছে, এত মানুষ, কিন্তু গিন্নিমা নেই কেন? অনবরত বক বক করা মালিকই বা কেন নীরবে গা ঢেকে শুয়ে আছে দিনভোর। মাঝে মাঝে সবার দিকে তাকাতে তাকাতে যেন বলছে প্রভুর গায়ের সাদা চাদরটা খুলে দিতে। সাহস পাচ্ছেনা। পরিচিত কেউ ঘরে ঢুকলে ছুটে গিয়ে তার পোশাক কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ডিভানের দিকে। কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য!

                 চার্বাকপ্রিয়া গাড়ী থেকে নেবে আলুথালু বেশে লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে উঠে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে সোজা উঠে এলেন ওপরে।  সবাই হাতের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে হুড়মুড় করে তাঁর পাশে আসার কসরত করতে লাগলেন যাতে টিভির ক্যামেরায় তেনাদের মুখশ্রী ধরা পড়ে। ক্যামেরা লেখকপত্নীর  ছবি তুলতে তুলতে যাচ্ছেন পেছন ফিরে হাঁটতে হাঁটতে। ধারাভাষ্যকার মাউথপিসটা হাতে ধরে পাশে পাশে এগুচ্ছেন -

                  “এখন কিন্তু আপনারা কিন্তু সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু।  চার্বাকের মরদেহ কিন্তু শুয়ে আছেন ডিভানে। তাঁর সম্পূর্ণ দেহ কিন্তু সাদা কাপড়ে ঢাকা। তার ওপরে ফুলের পাহাড়। আপনারা কিন্তু সদ্য স্বামীহারার উচ্চকণ্ঠের বিলাপ শুনছেন। কিন্তু উপস্থিত অনেকে তা সহ্য করতে না পেরে কিন্তু কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। লেখক যে কত জনপ্রিয় ছিলেন তা আপনারা কিন্তু বুঝতে পারছেন। চার্বাকপত্নী লুটিয়ে পড়লেন স্বামীর পদতলে। গিন্নিমাকে দেখে কিন্তু সাহস পেয়ে অবলা পশুটি লাফিয়ে কিন্তু ডিভানে উঠে পড়লো কিন্তু ঘেউ ঘেউ করতে করতে।  অনেক কিন্তু সয়েছে সে। আর কিন্তু অপেক্ষা করতে পারল না। ঢাকা দেওয়া সাদা চাদরটা কামড়ে টান মেরে কিন্তু ফেলে দিল মেঝেতে। আমি প্রকাশকে কিন্তু অনুরোধ করছি ক্যামেরাটা মৃতের মুখের দিকে ফোকাস, মানে কিন্ত ফো-কাস  .........

               ভাষ্যকার ছোকরাটি তোতলাতে তোতলাতে আচমকা থেমে গেলেন। ডেড সাইলেন্স। যাঁরা ডিভান ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা হঠাৎ করে পরিত্রাহি চিৎকার করে পিছিয়ে গেলেন ডিভানের পাশ থেকে। মনে হচ্ছে যেন বাঘ বা ভুত ঢুকে পড়েছে ঘরে।  চারিদিকে হুড়োহুড়ি। কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। পদপিষ্ট হবার ভয়ে  সবাই দেয়ালের দিকে আশ্রয় নেবার চেষ্টা করছেন। বিমূঢ় ভাষ্যকারের ফ্যাকাসে মুখে ভাষা নেই। ক্যামেরার হাত থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে ভাষ্যকার সাহস সঞ্চয় করে অনেক ‘কিন্তু’ সহযোগে আবার কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে শুরু করলেন, “আপনারা কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন, .......কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন ..... মানে দেখতে পাচ্ছেন, মৃত চার্বাকের দেহ কিন্তু উঠে বসেছেন। আপনারা কিন্ত, মানে কিন্তু দেখছেন তাঁর চোখে সাঁটানো তুলসীপাতাটা উড়ে গেল পাখার হাওয়ায়। চোখ দুটো তাঁর পিট্ পিট্ করছে।  মুখে কিন্তু তার সেই পরিচিত কৌতুকের হাসি।  চার্বাকপ্রিয়া  কাঁদতে কাঁদতে হাসতে হাসতে তাঁর পিঠে কিন্তু ক্রমাগত মেরেই চলেছেন আদুরে ঘুঁষি, আর কৌতুকের কান্নার মাঝে মাঝে  চিৎকার করে বলছেন, মরবে কেন, তাহলে আমার হাড় মাস খাবে কে?  সাহিত্যিকের কুকুরটি তাঁর কোলে উঠে তাঁর গালটা চেটেই চলেছে, চেটেই চলেছে.......   

             যমালয়যাত্রার পথে মাঝরাস্তা থেকে সাহিত্যিকের ফিরে  আসা দেখে সবাই এত আনন্দ পেয়েছে যে তাঁর ভায়রাভাই উপস্থিত সবাইকে ডিনারেরও মৌখিক নেমন্তন্ন করার পর ক্যাটারারকে ফোন করতে লাগলেন নির্দেশমাফিক পুরো অর্ডার শিগগির ডেলিভারি দিতে।   

              টিভি ভাষ্যকারের অনুরোধে চার্বাক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “ আসলে আমার নিজেকে সৎভাবে চেনার ইচ্ছে হয়েছিল। জীবিতাবস্থায় বুঝতে পারতাম না কে আমায় সত্যিকারের ভালোবাসে। সাদা কাপড়ের আড়াল থেকে এত মানুষের আগমন, মানুষের ভালোবাসা দেখে, সবার মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে আমার প্রশংসালোভী আত্মাটা আপাতত স্বর্গে উঠতে অস্বীকার করলো। যমরাজও তাঁর আদেশের টেম্পোরারি স্থগিতাদেশ দিলেন পুনর্বিবেচনা করে। বেয়াড়া আত্মাটার আরও কিছুদিন আনন্দময় পৃথিবীতে থাকার ইচ্ছা। মাঝপথে  আকাশ থেকে নেবে এসে সেটা আবার যীশু খ্রিস্ট  হয়ে গেল এই বুকের মধ্যে।”

                                                  [শেষ অংশ শেষের পাতায় ]

               ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি বুকের ওপরের ফুলের তোড়ার পাহাড় সরে গিয়ে সাদা পাঞ্জাবীর ওপরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা আছে  “এপ্রিল ফুল” 

             

COSMOPOLITAN 

A-128,Metroplitan,

5th Lane,Kolkata 105

দুর্নীতিযোগ (রম্যরচনা) -
অশোক দাস চার্বাক
Dec. 3, 2024 | রম্যরচনা | views:769 | likes:0 | share: 0 | comments:0

[শ্রী শ্রী গীতার উনিশতম অপ্রকাশিত অধ্যায়। রম্যরচনাটি               ইতিহাসসিদ্ধ নয়, ধর্মশাস্ত্র পুরাণাদির মত সম্পূর্ণ কাল্পনিক                                     একটি গণগুজব]          

        অত:পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবভাষায় উবাচ - আরেএ, অর্জুন ইয়ার, তুমি দেখিতেছি মহা বুদ্বু! পুণ্যতীর্থ কুরুক্ষেত্রের মহাসমরে অনুষ্ঠিতব্য দুর্নীতির কথা ভাবিয়া তুমি অযথা সেন্টিমেন্টাল হইয়া পড়িতেছ! সিংহাসন দখলের ধর্মযুদ্ধে  দুর্নীতি  হইবেনা, ভোটে নেতাদের স্বেচ্ছাসেবী ফড়িয়ারা ছাপ্পাভোট মারিবেনা, সমাজবিরোধী মা মাটি মানবসেবীরা প্রক্সীভোট দিবেনা, চোরডাকাতেরা চুরি ডাকাতি করিবেনা, সাধুবাবারা বুজরুকি করিবেনা, জ্যোতিষীরা লোক ঠকাইবেনা, নেতা- মন্ত্রী চোরাকারবারীরা কালো টাকা জমাইবেনা, কালো কালো মা লক্ষীরা মেঝের তলায় লুকাইয়া, ব্যাঙ্ক বা সিন্ধুকে বন্দী হইয়া চাকুরীচোর,গরুচোর ইত্যাদী সমাজবিরোধীদের ঘর 'আলো করিবেনা'  - ইহা কিরূপে সম্ভব। ভু ভারতে এসব অবাস্তব কথা কে কবে শুনিয়াছে,না দেখিয়েছে?

        শোন বন্ধুবর, রাজাকে অবশ্যই দুর্নীতিগ্রস্থ হইতে হয়। চুরি ডাকাতি, খুন খারাবী, সমুদ্রমন্থণাদিতে প্রতারনা করিয়াই সত্যযুগে দেবত্বলাভ, দ্বাপরযুগে রাজত্বলাভ এবং কলিযুগে নেতাত্ব ও মন্ত্রীত্বলাভ করিতে হয়। যুগ অনুযায়ী ভক্ত, প্রজা বা ভোটারগণের পকেট কর্তন,প্রয়োজনে তাহাদের মস্তক ছেদন করিয়াই দেববিলাস,রাজবিলাস, মন্ত্রীবিলাস নেতাবিলাস ইত্যাদি করিতে হয়। রাজার সিংহাসনই বলো, মন্ত্রীর শৃগালাসনই বল, ডাকাত নেতাদের গুপ্তধনই বল - সবই দুর্নীতির ফসল। সেই চোরাই মালের বখরা লইয়া এই যে ধর্মযুদ্ধ ঘটিতে চলিয়াছে  তাহারতো গোড়াতেই দুর্নীতি। কিন্তু জানিও যে এই দুর্নীতি ধর্মসম্মত এবং এ যুদ্ধ অবশ্যই আগামী কলিকালের  ভোটযুদ্ধের মত ধর্মযুদ্ধ। দুর্নীতি দুর্নীতি বলিয়া শোরগোল তুলিয়া এ যুদ্ধে বিরত হইলে তুমি মহাপাতকী হইবে।  দেবতাগণ তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করিবেন, কেননা তাঁহারাও   চোরাইমালের বখরার নৈবেদ্যলাভ কাটমানিলাভ করিয়া দেবতাগিরি,নেতাগিরি ইত্যাদি করেন। দেবনীতি, রাজনীতি,নেতানীতি, প্রজানীতি,ভোটারনীতি মানেই দুর্নীতি। ভবিষ্যত কলিকালের গণতান্ত্রীক রাষ্ট্রে   বর্ণচোরা আপাত 'সৎ' (কেতনা ত্বক) ভোটারগণ দুর্নীতি করিবার সুযোগপ্রাপ্তির গোপন আশায়-অভিপ্রায়ে  দুর্ণীতিগ্রস্ত  দুর্নীতিঅভিজ্ঞ  নেতা মন্ত্রীগণকেই ভোট দিয়া মন্ত্রী সিংহাসনে বসাইবেন। দুর্নীতি করিবার সুযোগ না পাইলে দলবদল করিবেন, অথবা নুতন দল ফ্লোট করিবেন। অতএব তুমি দুর্নীতি  ত্যাগ করিওনা। মেকিয়াভেলী, চাণক্য ইত্যাদী আগামী দিনের রাজনীতি বিজ্ঞানীরা এই উপদেশ দিবেন  বলিয়া আমার দিব্য চক্ষুতে দেখিতে পাইতেছি। দুর্নীতি করিতে করিতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা ফাটাইয়া বক্তৃতা দাও, টিভির তর্কসভায় গাল ফোলাইয়া, গলা ফাটাইয়া ঝগড়াকলহ কর, বিদ্বজনের সেমিনারে গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দাও, ইহাতে কোন ক্ষতি নাই। এই পবিত্র শঠতায় সরল পাবলিক বেশ গ্যাস খাইবে। চীৎকার চ্যাঁচামেচি কুরুচিকর গালমন্দ করিবার গণত্রান্ত্রিক অধিকার লাভ করিয়া কৃতার্থ হইবে। পেট খালি থাকিলেও মন ভরিবে। তাহারা সন্তুষ্ট থাকিয়া ক্রোধ প্রশমিত করিবে। তাহাদের সুগার প্রেসার কমিবে। তাহা বলিয়া পবিত্র দুর্নীতিকে সমূলে পরিত্যাগ করিবে - ইহা কদাপি ধর্মসম্মত বাস্তবসম্মত  নহে। 

           হে প্রিয়সখা, হস্তিনাপুরের রাজত্বে তোমাদের কোন আইনসম্মত অধিকার নাই।  জুয়া খেলিয়া সবই খোয়াইয়াছ। অজ্ঞ  লোকে বলিবে, সে তো কপট জুয়া - বেআইনী। কিন্তু হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ, বেআইনী চুরি,আইনসম্মত চুরি বলিয়া যেমন আলাদা কিছু হয়না, তেমনি জুয়া ইজ জুয়া, চুরি ইজ চুরি, আবার জুয়াচুরিও জোচ্চুরি, চাকুরীচুরি গরুচুরি, কয়লাচুরিও চুরি। জুয়া নীতিসম্মত না হইলেও ধর্মসম্মত। কপট জুয়াও জুয়া, সৎ জুয়াও জুয়া।খাঁটি মদও মদ, আবার ভেজাল চোলাইও মদ। স্বর্গের কারণবারীও মদ আবার সুইজারল্যান্ডের হুইস্কি বা রাশিয়ার ভোদকাও মদ।  ভোটযুদ্দ্বে সরলমতি ভোটারকে আলফাল বোঝাইয়া, পঞ্চ বৎসর পূর্বের  ভোটে  দেওয়া তামাদী প্রতিশ্রুতিগুলি রিনিউ বা ঘুষ প্রদান করিয়া অথবা ছাপ্পা ভোট,বুথ দখল ইত্যাদী ন্যায়সঙ্গত শাস্ত্রসম্মত দুর্নীতির দ্বারা ভোটে জয়লাভ করাও জেতা। বোমা মারিয়া, ভয় দেখাইয়া জয়লাভ করাও জেতা। আবার কালো টাকার বিনিময়ে মীরজাফর এম এল এ, এম পি,কাউন্সিলার ইত্যাদী লাইভস্টক ক্রয় করিয়া দুর্নীতি করিবার অধিকার দখল করাও জেতা। 

               হে পাণ্ডবকুলতিলক, চিন্তা করিয়া দেখ, রাজত্ব খোয়াইয়াছ।এখন খাইবে কি করিয়া। রাজার সন্তান হইয়াতো আর কৃষিজীবী, গোপালক বা আমার মত রাখালবালকদিগের মত খাটিয়া খাইতে পারনা। পূজনীয় দেবদেবী,সম্মানীয় যুদ্ধে হারা রাজা মন্ত্রী,ভোটে হারা মাননীয় নেতা মস্তানগন অনভ্যস্ত হস্তে হাপর টানিয়া বা লাঙ্গল চালাইয়া দেববিলাস, রাজবিলাস, নেতা বিলাস, মস্তানবিলাস করিবে - ইহা বিধিসম্মত নহে। সশস্ত্র ডাকাতির সাহায্যে অপরের রাজ্যের দখল লইয়া প্রজাশোষণ করিয়াই তোমাদের খাইতে হইবে।  

              ভগবান সঞ্জয় তখন  অর্জুনের কানের কাছে আস্তে আস্তে বলিলেন,হে তৃতীয় পান্ডব, পরিকল্পনা ছিল কোনক্রমে পাঁচখানা গ্রামের দখল লইয়া ধীরে ধীরে পুরা রাজ্য দখল করিবে।  সুঁচ হইয়া ঢুকিবে আর ফাল হইয়া বাহির হইবে। কিন্তু ধূর্ত কৌরবরা তোমাদের মতলব ধরিয়া ফেলিল।  সে কারণে পাঁচখানা গ্রামের প্রজাশোষণের সামান্য বখরাও দিতে কৌরব পার্টি রাজি হইলনা। তোমাদর  কারসাজি ফাঁস হইয়া গেল। অতএব এখন আর কোনো উপায় নাই। যেনতেন প্রকারেন যুদ্ধ জয় করিয়া  পুরা রাজ্যের দখল লইতেই হইবে। এখন ন্যায় নীতির কথা কপচাইলে না খাইয়া  মরিবে। তুমি শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ। অস্ত্রবলে বলীয়ান তুমি। তোমার তীরের ফলাই শক্তির উৎস।  ন্যায়নীতি, আইনাদী দুর্বল অক্ষম এলেবেলে ভদ্রলোকেদের নিমিত্য সৃষ্টি হইয়াছে, তোমার মত বীরের জন্য নহে। দুর্নীতি দর্শনে গেল গেল রব তুলিয়া বিচলিত হওয়া তোমার শোভা বর্ধন করেনা।  প্রয়োজন হইলে তিনশো ছাপ্পান্ন বা ইমার্জেন্সি জারি করিয়া ন্যায়ধর্মের ভন্ডামীটাও মন-গাত্র হইতে ঝাড়িয়া ফেল।  পবিত্র ভারতভূমিতে সনাতন   দুর্নীতিধর্ম পালন কর। এই দুর্নীতিধর্ম রক্ষা করিতে আমি  যুগে যুগে আবির্ভুত হই। আমিই সব কৰিব।  তুমি সরকারী আমলা রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির রবারস্ট্যাম্পের  মত নিমিত্তমাত্র।  

        হে মহামতি অর্জুন, আমার বাম চক্ষুর দিকে তোমার চক্ষু নিবদ্ধ করিয়া অতীতের ইতিহাস প্রতক্ষ কর। কি দেখতেছ?অবতারগণের শ্রেষ্ঠ মডেল মাননীয় রামচন্দ্রও রাজত্ব হারানোর আশঙ্কায় দুর্নীতির আশ্রয় লইতেছেন।পাবলিকের নো  কনফিডেন্স মোশানের ভয়ে ভীত হইয়া সরলমতি পত্নীর সহিত চারশোবিশ করিয়া বেচারাকে বাড়িছাড়া করিতেছেন। দুষ্ট চক্রীদের ছড়ানো কেচ্ছা গুজব সম্পূর্ণ মিথ্যা বুঝিয়াও তাঁহার পতিব্রতা সতীকে বিনা অপরাধে অত্যন্ত বেআইনিভাবে চক্রান্ত করিয়া  তালাক দিতেছেন। ভাই লক্ষণের সাথে ষড়যন্ত্র করিয়া সরলমতি রাজরাণীকে তাঁহার অজান্তে বনবাসে পাঠাইতেছেন।প্রাপ্য খোরপোষও দিতেছেননা। অসহায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মরিল কি বাঁচিল সে সংবাদও লইলেননা। স্ত্রী পুত্রদের কথা বেমালুম ভুলিয়া রাজবিলাসে গা ভাসাইতেছেন। এমনকি এই আদর্শ অবতার নিজ স্ত্রীকে আত্মহত্যা করিতে পর্যন্ত প্ররোচিত করিতেছেন। তথাপি ধর্মপ্রাণ ভারতবাসীগণ তাঁহাকে হৃদয়হীন দুর্নীতিগ্রস্থ অপবাদ দিয়া গালমন্দ করিলনা।  রাজপদ পরিত্যাগ করার দাবীতে প্রজাগণ বন্ধ হরতালও ডাকিলনা, সীতাও ৪৯৮এ করিলনা, সি বি আইও রামের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিলনা। উপরন্তু আজও তাঁহাকে তাঁহারা মাথায় তুলিয়া পূজা করিতেছেন, তাঁহার আঁতুড়ঘরের দখল লইতে মারামারি কাটাকাটি, দাঙ্গা হাঙ্গামা, কোর্ট কাচারী করিতেছেন। ভবিষ্যতের কলিকালেও দেশবাসীর হৃদয়ে তিনি আদর্শ রাজা,আদর্শ স্বামী, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ শাসক হিসাবে বিরাজ করিবেন।  তাঁহার সেই সনাতন আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া নরকভীরু দেবভীরু মহান ভারতবাসীগন বধূহত্যা, বন্ধুহত্যা,ম্লেচ্ছহত্যা, পরধর্মীহত্যা, হরিজনহত্যা, নাস্তিকহত্যা ভিন্নমতবাদীহত্যা ইত্যাদী পুণ্যকর্ম করিতে উদ্বুদ্ধ হইবেন। কলিকালের উচ্চতম দেশশাসকেরাও সতী গৃহবধূকে ভরনপোষণতো দূরের কথা, নিজ ঘরে প্রবেশ করিতে পর্যন্ত অনুমতি দিবেননা। তাঁহার আধ্যাত্বিক  আদর্শ ভারতভূমিতে  জাতীয় আদর্শে পরিণত হইবে। সেই আদর্শ অনুকরন করিয়া সে দেশে কলিকালের ভবিষ্যতকালে  পুনরায় রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবে। জয় রামসীয়ারামকি।

               হে মহাধানুকী, আমি ত্রিকালজ্ঞ। তুমি আমার এক চক্ষুতে অতীতের দৃশ্যের প্রতিফলন দেখিতে পাইবে। আবার আমার অপর চক্ষুতে ভবিষ্যতের দৃশ্যের প্রতিফলন দেখিতে পাইবে।   এইবার বল  তুমি কি দেখিতেছ? তুমি দেখিতেছ এই আদর্শ পুরুষ মনুকৃত ন্যায়নীতিহীন আইন পূতিগন্ধময় শাস্ত্র অনুযায়ী কিভাবে শম্বুকবধ করিতেছেন। রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়া রক্তাক্ত শম্বুকমুন্ড দেখিয়া অমানুষ দেবতাগণ আনন্দনৃত্য করিতে করিতে হত্যাকারীর মস্তকে পুষ্পবৃষ্টি করিতেছেন। কেননা দুর্নীতিই পরম ধর্ম। মহামতি রামচন্দ্র সেই মহান ধর্ম রক্ষা করিলেন। পাপী শম্বুক  নিম্নশ্রেণীর ঘৃণ্য জাতির সন্তান হইয়াও জ্ঞানার্জনের জন্য সচেষ্ট হইয়াছিল। এই অভিপ্রায় ধর্মবিরোধী পাপকর্ম। ইহাতে স্বর্গের দেবতাগণ লজ্জিত হইতেছিলেন। পৃথিবী পাপে ভরিয়া যাইতেছিল। মহামতি রামচন্দ্র শূকরবৎ  নিম্নজাতির শুম্বককে খুন করিয়া দুর্নীতিধর্ম রক্ষা করিলেন। তিনি ধন্য, তিনি আদর্শ পুরুষ। তিনি পুরুষোত্তম। সে কারণে পিতৃপুরুষের হত্যাকারীকে পূজা করিবার অধিকার পাইবার জন্য শম্বুকের বংশধর নিচু জাতির ভবিষ্যতের মানুষেরা আন্দোলন করিতেছেন। পিতৃহত্যাকারীকে পূজা করিবার অধিকার জয় করিয়া আনন্দে ডগমগ হইতেছেন। 

                  হে তথাকথিত তৃতীয় পান্ডব! দুর্নীতি সর্বত্র। অধিক আর কি বলিব, তোমার জন্মেও দুর্নীতি। তোমরা কুন্তীপুত্র, মাদ্রিপুত্র বটে, কিন্তু তাহা বলিয়া সন্তান প্রজননে অক্ষম পান্ডুর ঔরসে তোমাদের জন্ম হয় নাই। তোমরা কদাপি পাণ্ডব নও।  রাজত্বের দাবী ন্যায়সঙ্গত করিবার নিমিত্বে ঘুরপথে তোমাদের পাণ্ডবপুত্র সাজানো হইয়াছে মাত্র। 

              হে শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজ, আবার বিবেচনা কর, চন্দ্রদেবকে ব্যভিচারী,ইন্দ্রদেবকে লম্পট, অথবা ব্রহ্মাকে নিজকন্যাগামী দুর্নীতিপরায়ণ আখ্যা দিয়া কেহ ঘৃণা করেনা। আমার নিজস্ব পরনারীগামী পরকীয়া লীলাও ধর্মীয় ব্যাখ্যা টিকাটিপ্পনীর ছলচাতুরীতে ধর্মসিদ্ধ ও কালে কালে আদালত দ্বারা আইনসঙ্গতও হইয়াছে। আমার শত শত নারীলীলার উপাখ্যানের বর্ণনাকীর্তন করিতে করিতে আমার ভক্তগণ দু হাত তুলিয়া নাচিতে নাচিতে, বাতাসা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে, আবীর মাখিতে মাখিতে, চক্ষের জলে বুক  ভাসাইতে ভাসাইতে নগর কীর্তন করিয়া পুণ্যলাভ  করিতেছে। নির্জন কুঞ্জবনে ডজন ডজন গোপিনীদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করিতে সচক্ষে দেখিয়াও  নীতিপুলিশগণ আমাকে কান ধরিয়া উঠবস না করাইয়া আমাকে পূজা করিতে লাগিল। এইরূপে কলিকালে দেবতা সমান নেতাগণের ভোটচুরি,মন্ত্রীত্ব চুরি,চাকুরী চুরি, পুকুর চুরি, গুরুবাবাদের জোচ্চুরী প্রভৃতি দুর্নীতির অকাট্য প্রমান পাইয়াও ভোটারগণ সেই  দুর্নীতিগ্রস্থ নেতাদের ভোট দিয়া গলায় মালা পরাইয়া তাহাদের শোষকগদিতে বসাইবে। গুরুবাবাদের শিষ্যরা জেলখানাবাসী মহামান্য ধর্ষক গুরুবাবাদের ভেট দিবে, তাহাদের পূজা করিবে। কেননা দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসকরাই তাহাদের দুর্নীতি করিবার সুযোগ করিয়া দিবে। 

              হে কৃষ্ণসখা, আমার বাক্য মন দিয়া শ্রবন কর। পবিত্র দুর্নীতি নারায়ণের অংশ। দুর্নীতিই ব্রহ্ম।  কি স্বর্গে, কি মর্ত্যে, কি সত্যযুগে, কি কলিযুগে, ইস্কুলে,কলেজে,  হাসপাতালে, অফিস আদালতে,দেবস্থানে গোরস্থানে  - দুর্নীতি সর্বত্র সদা বিরাজমান। প্রাকৃতিক মানবধর্ম ছাড়া বাকি সমস্ত মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম  ধর্ম, ধর্মীয় শাস্ত্র, ধর্মীয় প্রথা ও নিয়মকানুনে দুর্নীতি প্রচ্ছন্ন।  ধর্ম ও ঈশ্বরের জন্মও মিথ্যার গর্ভে, দুর্নীতির ঔরসে।  একথা জানিও যে when rationality ends, religion begins. প্রতিনিয়ত নুতন জ্ঞান অর্জনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায়  যুক্তিবাদী জ্ঞানের সীমানা যে স্থানে শেষ হয়, সেই স্থানে ধর্মের উৎপত্তি হয়।  ঝড় বৃষ্টি বন্যা গ্রহণ ইত্যাদির যথাযথ প্রাকৃতিক কারণ না জানা থাকায়  চতুর অসৎ দূর্ণীতিগ্রস্হ মুনি ঋষিরা পবনদেব-বরুণদেব, রাহু-কেতু ইত্যাদীর মিথ্যা গল্পগুজব ফাঁদিয়া প্রচার করিয়া নিজ নিজ অজ্ঞতা গোপন করিয়াছেন এবং করিতেছেন। আর সরলমতি দৈবভীত ভক্তগণ প্রকৃতিদত্ত চিন্তনশক্তিকে নিশ্চল করিয়া সেই গুজবগুলিকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতেছেন। অতএব হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ, তুমি ধর্ম রক্ষার্থে দুর্নীতি করিতে বিচলিত হইওনা।  

               নেতা দেবতাদের পেটে টোকা মারিলে দুর্নীতির দুর্গদ্ধে পৃথিবী ভরিয়া যাইবে। রাজা-দেবতাগন মানবের শ্রদ্ধাভক্তি হারাইয়া কাটমানি নৈবেদ্যাদিবঞ্চিত হইবে। অসিযুদ্ধ অথবা ভোটযুদ্ধের পরে দেশে রাজা মন্ত্রীর পরিবর্তন হয়। কিন্তু নুতন গদিতে বসা নেতা  পুরানো নেতামন্ত্রীকৃত দুর্নীতি ধরাইয়া দিবার ভয় দেখাইলেও কিভাবে আইনের কানাগলির আড়ালে ও মহামান্য আদালতের অসহায়তার সুযোগে সেসব দুর্নীতি ধামাচাপা দিতেছেন তাহা প্রত্যক্ষ কর। তাঁহারা  দূর্ণীতিগ্রস্থ তাঁহাদের সহধর্মী পূর্ববর্তী নেতামন্ত্রীদের শাস্তিপ্রদান করিতেছেননা।  বন্দী পুরুরাজ যেমন আলেকজান্ডারের নিকট রাজার অনুরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা করিতেছেন, দুর্নীতিগ্রস্থ প্রাক্তন নেতা মন্ত্রীরা কলিযুগে তেমনি সমসাময়িক নেতামন্ত্রীদের নিকট অনুরূপ ব্যবহার প্রত্যাশা করিতেছেন। বর্তমানের দুর্নীতিগ্রস্থ প্রশাসক পূর্ববর্তী প্রশাসকদের দুর্নীতির শাস্তিবিধান করিতেছেননা। 

        হে মহামতি অর্জুন, আমি ত্রিকালজ্ঞ। এবার তুমি আমার দক্ষিণ চক্ষুর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া ভবিষ্যৎ অবলোকন করিতে থাক। ঐ যে শ্বেতপাথরের দেবতাবাসটি দেখিতেছ, মঠ মন্দির দেখিতেছ - ওগুলি কিভাবে নির্মিত হইয়াছে? হাজার হাজার ক্রীতদাসের রক্তে, তাহাদের শ্রমে, তাহাদের  ঘামে দুর্নীতিগ্রস্থ দেবগন স্বর্গলোভ দেখাইয়া, ক্যাডার ভক্ত নিয়োগ করিয়া তাহাদের বিলাসভবন বানিয়াছেন। ফলস্বরূপ মানবসন্তানগন অনাহারে অপুষ্টিতে মরিয়াছে।  কোনারকমন্দির গড়িবার ফলে দশ বৎসরকালব্যাপী দুর্বিক্ষে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাইয়াছে। যখন ঝড় বৃষ্টি রৌদ্রে অমৃতস্য পুত্র মানবসন্তানগন মাথার উপর সামান্য আচ্ছাদন পাইতেছেনা,তখন দুর্নীতিগ্রস্থ দেবগন মানবের সম্পদ লুণ্ঠন করিয়া কিভাবে মন্দিরবিলাস অট্টালিকাবিলাস করিতেছেন তাহা প্রত্যক্ষ কর। কিন্তু ইহাও জানিও যে, এই দুর্নীতি অন্যায় হইলেও ধর্মসম্মত। ভবিষ্যতের নেতা মন্ত্রীগণ এইভাবে রাজভবনবিলাস, পাঁচতারা হোটেলবিলাস,রিসর্টবিলাস করিবার জন্য জনগণের নিকট তোল্লা কাটমনি আদায় করিবে। And these  corrupted Brutases are honourable men. এবং এরূপ পাপকর্ম ধর্মসম্মত।  

              হে পার্থ! চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া দেখ। যখন অমৃততস্য পুত্র মানবসন্তানেরা অনাহারে মরিতেছে, তখন দুর্নীতিগ্রস্থ দেবগন তাঁহাদের সহযোগী নেতা মন্ত্রী আমলা গুরুবাবা পুরোহিতগন কিভাবে বিলাসবৈভবে অলস দিনপাত করিতে করিতে লীলা করিতেছেন, কিভাবে দেবদাসী,পুরনারীদের সহিত ফস্টিনস্টি করিতেছেন। কিভাবে তাঁহারা ধূপধুনা,পুষ্পচন্দনাদি বিলাসদ্রব্যের সৌরভ সেবন করিতেছেন, কিভাবে বলির পশু,এমন কি মানব রক্ত পান করিয়া জিহ্বা মুখমন্ডল রক্তরঙে রঞ্জিত করিয়া অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের ভয় দেখাইয়া টেররাইজ্ড করিতেছেন। কিভাবে অসহায় ফুলগুলির বৃন্তচ্চুত মৃতদেহ অঙ্গে ধারণ করিয়া নিজ নিজ অঙ্গশোভা বৃদ্ধি করিতেছেন। 

                সঞ্জয় আরও উবাচ,আমি ত্রিকালজ্ঞ।  সুদূর ভবিষ্যতে কি ঘটিতেছে তাহা আমি আমার দিব্যদৃষ্টিতে অবলোকন করিতেছি। পুরাকালের ঘটনাবলীও আমার নয়নে কলিকালের টিভির ছবির মত  ফুটিয়া  উঠিতেছে। আমার চোক্ষুদ্বয়ে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কলিযুগের বিস্বরূপ দর্শন কর। 

                 অতঃপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কমললোচনের দিকে চক্ষু রাখিয়া শ্রীমান অর্জুন বলিলেন, সবুজ,গেরুয়া, সাদা নানা রঙের, নানা ধর্মের নানা ভগবানগণ তাঁহাদের প্রতিপক্ষ ভাগবানদের ভক্তদের ভাড়াটে গুন্ডার দ্বারা গুপ্তহত্যার ফতোয়া জারি করিতেছেন। মন্ত্রীরা গবাদি পশুদের যাবনা চুরি করিয়া উদরপুরণ করিতেছেন,কিভাবে গণেশজী মহারাজ শিশুদের দুগ্ধ চুরি করিয়া উদর স্ফীততর করিতেছেন, কিভাবে অপুষ্ট শত শত শিশুদের অনাহারে রাখিয়া তাহাদের দুগ্ধে লিঙ্গ শোধন করিতেছেন, কিভাবে পূজা লইবার ছলে ভক্তদের দেবস্থানে আমন্ত্রণ করিয়া পূজারত ভক্তগণকে কখনো জলে ডুবাইয়া, কখনো আগুনে পোড়াইয়া, কখনো পদপিষ্ট করিয়া, এমনকি পবিত্র শিন্নিতে বিষ  মিশাইয়া গণহত্যা করিতেছেন। চিড়িয়াখানার বিশ্বাসঘাতক শেরওয়ালীমাতা সরলমতি গুজববিস্বাসী ভক্তের ঘাড়  মটকাইয়া তাহার রক্ত পান করিতেছেন, নানা ধর্মের ভগবানভাইগন নরকের ভয় ও স্বর্গলাভের  লোভ দেখাইয়া ভীরু,দুর্বল  মনুষ্যদের নৈবেদ্য শোষণ করিতেছেন।  প্যারিস, নিউইয়র্ক,বালিতে নির্বোধ ধৰ্মোদ্মাদ ধার্মিকদের দ্বারা গণখুন করাইতেছেন।  স্বর্গীয় শুঁড়িখানায় বিনাপয়সায় কারণবারি  বিলাসব্যাসন, বেহেস্ত /স্বর্গের  ফ্রী পৌনপৌনিক  গণিকাভোগের লোভ দেখাইয়া টুইন টাওয়ার,তাজ হোটেলে গণহত্যায় প্ররোচিত করিতেছেন। আর দুর্নীতিগ্রস্থ পরজীবী পুরুত মোল্লা যাজকদের দক্ষিণা / কমিশন লুন্ঠন করিবার ব্যবস্থা করিতেছেন।  

                আরো দেখিতে পাইতেছি কলিযুগের দেবদেবীগণ ধর্মে দুর্বৃত্তায়ন করিতেছেন।  নিজ নিজ ঘরবাড়ি, প্রভাব প্রতিপত্তি, জমি জায়গা দখল ও রক্ষার্থে বিভিন্ন সাম্রদায়ের ভগবানগন পরস্পর  নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি মারামারি করিতেছেন। নিজ নিজ পার্টি ক্যাডার নিয়োগ করিয়া এক ভগবান অন্য  প্রতিযোগী ভগবানদের ঘরবাড়ী  আঁতুরঘর ভাঙিতেছেন, রাস্তাঘাট ফুটপাথ পাবলিকসম্পত্তি জবরদখল করিতেছেন, প্রতিপক্ষ ভগবানের সমর্থক ভক্তদের খুন কারাইতেছেন, ধর্মীয় রায়ট বাধাইতেছেন। দেবদেবীরা রাজা নেতামন্ত্রীদের মত গুন্ডা মস্তান পুষিতেছেন, দেবদেবীসেনা মারফত বারোয়ারী পূজা চাঁদা তোলা আদায় করিতেছেন। দুর্নীতিতে মদত দিতেছেন। কেননা দুর্নীতিই ধর্মের প্রাণস্বরূপ। 

          সঞ্জয় বলিলেন, বেশ বেশ, আরো দর্শন কর। আমার বাম চক্ষুর দিকে তোমার দৃষ্টি ফিরাইয়া দ্বিতীয় চ্যানেলের ছবি দেখ।  কি দেখিতেছ?

           অর্জুন বলিলেন,দেখিতে পাইতেছি দেবদেবীদের বিচারব্যবস্থা। এক লালচাঁদ লালচাঁদ ঝুনঝুনওয়ালা - সারাজীবন চোরাকারবারী করিল, সিমেন্টে গঙ্গামাটি মিশাইল, ওষুধে ভেজাল দিয়া গণহত্যা করিল, দেনা না মিটাইয়া ব্যাংকের টাকা আত্মস্যাৎ করিল। সে থানার আর মন্দিরের দেবতাগণের বামহস্তে প্রচুর ঘুষ প্রদান করিতে থাকিল। সেই মহাপাপী দেবদেবীদের নামে সিন্নিপার্টি দিল, অষ্টপ্রহর নামকীর্তন করিয়া দেবদেবীদের চাটুকারিতা করিল। গঙ্গাসাগরে ডুব দিয়া, সাগরমন্দিরের দেবতা/পুরুতদের চোরাই সোনাদানা, কালো টাকা ইত্যাদী উৎকোচ প্রদান করিয়া তাহার সমস্ত পাপ সমুদ্রজলে ধুইয়া ফেলিল। দেবতাদের সমর্থনে নগরকীর্তন, মিটিং মিছিল করিতে লাগিল। দেবতাদের বিলাসের জন্য শ্বেতপাথরের মন্দির বানাইয়া দিল। দূর্ণীতিগ্রস্থ দেবদেবীরা পাপী লালচাঁদের পাপপুণ্যের লেজার একাউন্ট বেআইনিভাবে পাল্টাইয়া ফেলিলেন। পূজা, চাটুকারিতা,নৈবেদ্য-উৎকোচের বিনিময়ে তাহার সমস্ত পাপকার্য ধামাচাপা দিয়া দিলেন। চুরি দুর্নীতির সমস্ত প্রমান লোপাট হইল, চিত্রগুপ্ত কেরানীর লেজার পাতা অদৃশ্য হইল। প্রমাণাভাবে স্বর্গীয় সি বি আই, স্বর্গীয় আদালত কিছুই করিতে পারিলনা।    

                মহামতি অর্জুন তখন এরূপ ধর্মীয় অনাচার দর্শন আর সহ্য  করিতে পারিলেননা।  প্রবল উত্তেজনায় তাহার চক্ষুদ্বয় নিমীলিত করিয়া ফেলিলেন। শরীর এলাইয়া অশ্বসকটের সিটে শুইয়া পড়িলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাহাকে কোনোরকমে নিজ বক্ষে আকর্ষণ করিয়া প্রশান্ত কণ্ঠে কহিলেন, " হে প্রিয়সখা, চক্ষু উন্মোচন কর। দেবতাদের দুর্নীতি দর্শন করিয়া তুমি এরূপ উতলা হইওনা। নৈবেদ্য ঘুষ প্রদান ধর্মবিরুদ্ধ নহে। পূজাপাঠ,নৈবেদ্যপ্রদান ইত্যাদির দ্বারা পাপ ধামাচাপা দিয়া আখের গোছানো অনৈতিক বা অধর্মীয় কার্য্য নহে। বরং ইহাই ধর্মপালন, ধর্মীয় অভিনয়ের আসল উদ্দেশ্য। পাপী লালচাঁদ চরম দূর্ণীতিগ্রস্থ হইলেও সে ঈস্বরভীরু ধর্মপ্রাণ মানুষ। দেবতা,রাজা,নেতা মন্ত্রীদের উৎকোচ প্রদান,ভজন কীর্তন, যাগযজ্ঞ ইত্যাদী কুকর্ম হইলেও ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকর্ম।  ইহাতে পুন্য জন্মে, এবং সেই পুণ্যে মনুষ্যকৃত সমস্ত দুস্কর্মের শাস্তি মকুব হইয়া যায়। মৃত্যুর পরে নরকে যাইতে হয়না।  ইহাই সত্য। তুমি তোমার চক্ষু উন্মোচন করিয়া সত্যদর্শন কর।  সত্যকে স্বীকার করিয়া চিত্ত শান্ত কর। বল সখা, এইবার তুমি কি দেখিতেছ?

            - আমি দেখিতে পাইতেছি মৃত পাপীদের পুত্রকন্যাগন পিতামাতার পাপপুণ্যের লেজার-বালান্সশিট উল্টাপাল্টা করিবার অভিপ্রায়ে  পিতামাতার শ্রাদ্ধশান্তি করিতেছে।  তাহারা পুরহিত টাউটের থ্রু দিয়া নানা দান-ভেট -উৎকোচাদি দেবতাদের হস্তে প্রদান করিয়া মহাপাপী পিতামাতার সমস্ত অনাচার,দুস্কর্মজাত পাপ ব্যাকডোরে মকুব করাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিতেছে। দুর্নীতিগ্রস্থ দেবদেবীগণ উৎকোচের বিনিময়ে পাপীদের নরকের জেলখানায় না পাঠাইয়া স্বর্গরাজ্যের ভিসা মঞ্জুর করিতেছেন। তাহারা তাহাদের আজীবনকৃত দুস্কর্ম পাপের প্রাপ্য শাস্তি হইতে অব্যাহতি পাইতেছে।  

           অর্জুন আরো বলিলেন,হে পার্থসারথী! আপনার কৃপায় আমি দ্বিব্যদৃষ্টি লাভ করিতেছি।  সুদূর ভবিষ্যতের দৃশ্য আমার চক্ষুতে প্রতীয়মান হইতেছে।  আমি স্পষ্ট দেখিতেছি যে ধর্মীয় চাটুকারিতা নৈবেদ্য পূজা ইত্যাদীর বিনিময়ে দেবদেবীগণ মন্ত্রী আমলাদের মত তাঁহাদের পছন্দমত ভক্তগনকে নানা সুযোগ পাওয়াইয়া দিতেছে।  পূজা দিলনা বলিয়া যোগ্য বেকার চাকুরী  পাইলনা, গ্যাসের ডিলারশিপ, মদের দোকানের লাইসেন্স পাইলনা, অথচ অযোগ্য,অশিক্ষিত দুশ্চরিত্র ব্যক্তি পূজাপাঠ, জাগযোগ,  উৎকোচ প্রদান করিয়া দেবতাদের বেআইনীভাবে  সবই বাগাইয়া লইল। অশিক্ষিত শিক্ষকগণ স্কুলে শিক্ষাদান করিতে লাগিল। অযোগ্যরা চাকুরী চুরি করিল, যোগ্যরা রাস্তায় বসিল।   

             আরো দেখিতেছি যে ভোটফান্ড নেতাফান্ড ইত্যাদিতে তোল্লা প্রদান করিয়া দূর্ণীতিগ্রস্তরা পার পাইয়া যাইতেছে, খুনির শাস্তি মকুব হইয়া যাইতেছে,রাজারহাট,সল্টলেকে জমি পাইয়া যাইতেছে। প্রাসাদবাসীরা গৃহহীনদের প্রাপ্য অনুদানের অর্থ আত্মস্যাৎ করিতেছে। 

              তখন শ্রীকৃষ্ণ প্রবল আনন্দে হাততালি দিয়া বলিয়া উঠিলেন, " সাবাস অর্জুন ইয়ার, সাবাস।  তোমার বিশ্বদর্শন সম্পূর্ণ হইয়াছে। আর সময় নাই, আমার শেষ কথা শ্রাবন কর।  দুর্নীতি অবশ্যই অন্যায় এবং খারাপ কর্ম,  কিন্তু ইহা কদাপি পাপকর্ম নহে। অধর্মও নহে। বরং দুর্নীতি ব্যতিরেকে স্বর্গলাভ, রাজ্যত্বলাভ, মন্ত্রিত্ব, নেতৃত্বলাভ অসম্ভব। তুমি ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তুন হইতে বান তুলিয়া লও। বক্তৃতামঞ্চে, সংবাদ মাধ্যমে, টিভির তর্কসভায়   ভোটনেতাদের অসভ্য বাক্যবান নিক্ষেপের মত তুমিও শত্রুর দিকে বান ছুঁড়িতে শুরু কর।  শঠতাবলে, চাতুর্য্যবলে, বুদ্ধিবলে, ছলনাবলে,  বাহুবলে,,আইনের অপব্যাখ্যাবলে রাজত্ত্ব ছিনাইয়া লও। 

             কুরুক্ষত্রের এই ধর্মযুদ্ধ যুগে যুগে চিরকাল দুর্নীতিগ্রস্থ ধার্মিকদের পথ দেখাইবে। গীতার এই সর্বশেষ অধ্যায় ভক্তিভরে পাঠ করিয়া ধর্মপ্রাণ জনগণ একাধারে দুর্নীতিধর্ম পালন করিতে উদ্বুদ্ধ হইবে, অন্যধারে পূজাপাঠ, নৈবেদ্যঘুষ প্রদানে প্ররোচিত হইবে। উত্তরোত্তর দুর্নীতিধর্ম জনপ্রিয় হইবে, সাথে সাথে জবর দখল করিয়া দেবদেবীগণ শিশুদের খেলার মাঠ, জনসাধারণের চলার পথ জবরদখল করিয়া প্রনামীর বাক্সভ্রাইবেন। 

                অতএব হে কৃষ্ণসখা, জানিয়া রাখিও - নিষ্ঠাভরে দুর্নীতিধর্ম পালন করা, দুর্নীতিধর্ম প্রচার করা এবং মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্থ রাখা, তাহাদের দুর্নীতিগ্রস্থ হইতে বাধ্য করা সত্যযুগে দেবধর্ম,দ্বাপরযুগে রাজধর্ম ও কলিযুগে নেতাধর্ম। ইহাই সনাতন মৌলবাদী ধর্মের সার কথা - গীতার  সারমর্ম। যেদিন মানুষ পবিত্র দুর্নীতিধর্ম ত্যাগ করিবে সেদিন পৃথিবী পাপে পূর্ন হইবে।  দেবতাগিরি,রাজাগিরি, পুরুতগিরি, গুরুবাবাগিরি সমস্ত বৃত্তি ধরাধাম হইতে অবলুপ্ত হইবে।  সেই ভয়ঙ্কর দিনে দেবতা, রাজা, নেতা ফড়েদের খাটিয়া খাইতে হইবে।  

               সুতরাং হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! তুমি ধর্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। দেব দ্বিজ,রাজা মন্ত্রী, নেতা শোষকদের পবিত্র দুর্নীতি ধর্মের পথ দেখাও। তাহারা দূর্ণীতিগ্রস্থ ধার্মিক হউক। 

                অতঃপর কুরুক্ষত্রের যুদ্ধ শুরু হইল। নব নব যুগে, নব নব রূপে সে যুদ্ধ আজও চলিতেছে। ওং তৎসত - আমেন -

প্রথম প্রকাশ: ' অনির্বান ' শারদীয় সংখ্যা ১৪০৬ / ১৯৯৯

দ্বিতীয় প্রকাশ: চার্বাক রচনাবলী ২০১৬ (সামান্য সংযোজিত)

সমালোচনা ও ত্রুটিনির্ধারণ: asokdas.godless@gmail.com



দাদু কেন ধর্মত্যাগ করলো? -
অশোক দাস চার্বাক
Nov. 26, 2024 | ছোটোগল্প | views:2615 | likes:2 | share: 2 | comments:0

"Cogito ergo sum : I think, therefore I am" - Descartes 

     শুধু আহার্য্যগ্রহন বাথরুমগমন আর শয্যাবিনোদনের সময়টুকু বাদ দিয়ে অনবরত চলতো তাঁর মালাজপা। এমন কি ঘুমের মধ্যেও। স্বপ্নের ঘরে প্রায়ই হরিনাম উদ্গিরণ হতো দাদুর গলা দিয়ে ঘড়ঘড়িয়ে। সূর্য ডোবার সাথে সাথে 'হরি  দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে' গেয়ে হরিনাম, ভোরে উঠে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হরিনাম, শুতে যাবার আগে হরিনাম, হাই তোলার পাপ করার পরে হরিনাম, হাঁচিকাশির পরে হরিনাম, আনন্দে হরিনাম, দুঃখে হরিনাম, গড়গড়ার হুঁকো টানতে টানতে হরিনাম - মানে সদাসর্বদা পুন্যকাম। পুন্যকাজে মন তাঁর অটল।  মক্কেলদের ট্যাক্স ফাঁকি দেবার কৌশল বাৎলানোর ফাঁকে ফাঁকে, মেজদাদুর সাথে শেয়ারবাজারের পর্যালোচনা, রেডিওর খবর শোনা, পাশের বাড়ির জন্মশত্রু জ্ঞাতিভাইদের দাম্পত্য কলহে এরই পাতা, টিভির উন্মাদনৃত্য উপভোগ - কোনো কিছুই তাঁর মালাজপায় বিঘ্ন ঘটাটার পারতোনা। দাদু আমার সব্যসাচী। সব সময় তাঁর ঠোঁট কাঁপছে - গুরুবাবা গুরুবাবা আধবোজা আধ্যাত্যিক চক্ষুদুটি  ভক্তিতে গদ গদ, ভাবের ঘোরে ঢুলু ঢুলু - মালা জপার বিরাম নাই। দিদার বানানো লাল ন্যাকড়ার মধ্যে হাতের মালা লুকিয়ে নিত্য তাঁর গুটি গোনার গুনগুনানি, পুন্যগোনার বিড়বিড়ানি।  কপালে তিলক,গলায় তুলসী। শয়নে স্বপনে - বিজনে মননে অনুক্ষন তাঁর একই ভাবনা - পাপক্ষালন, আর পুণ্য অর্জন। বাড়িময় ধূপধুনোর ধূম্রদূষণ, কাঁসরঘন্টার ঝনঝনানি, রামভজনের প্যানপ্যানানি, শ্যাম বিরহের গানকাঁদুনি মধুমাখা কৃষ্ণনাম  শুনতে শুনতে কান বিষতেতো  যেত মামাবাড়ি এসে।  

          গঙ্গাতীরে প্ৰাতঃভ্ৰমণের সময় কীর্তনীয়াদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে নাচতে নাচতে কৃষ্ণনাম করতেন তিনি দুহাত তুলে। শরীর-স্বাস্থ্য, আনন্দ পুন্য বাড়তো তাঁর দেহ মন আত্মায় এক সাথে।  পরিচিতদের সাথে দেখা হলে 'নমস্কার' না বলে বলতেন 'জয় গোবিন্দ-জয় নিতাই'। আলাদা কোন পরিশ্রম না করে বাড়তি পুন্য ফোকটে।  স্নানের পর ঠাকুরঘরে পাক্কা আধটি ঘন্টা।  সে ঘরের ঠাকুর সিংহাসনে  ক্লাসিক্যাল ব্রহ্মা,বিষ্ণু, মধ্যযুগীয় কালী মনসা, নবাগতা সন্তোষীমাতা জয়মাতাদি, অত্যাধুনিক চন্দ্রস্বামী, বালক-নাবালক, জেলমন্দিরবাসী খুনী  রাম রহিম বাবা, পরমপূজ্য সপুত্র  ধর্ষকবাবা শঙ্করাচার্য  সবাই বসে থাকতো চোখবোজাদাদুর চোখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে  তাকিয়ে আশীর্বাদ দিতে দিতে। তাছাড়া দেওয়ালভর্তি দেওয়ালভর্তি অগুনতি ক্যালেন্ডার  দেবতারাও পেরেকে দুলতেন পাখার হাওয়ায়। আবার রথের মেলা থেকে কেনা কাঠের যীশু পেরেকবিদ্ধ হয়ে ঝুলতেন সেখানে। মাটির এক বুদ্ধদেবও চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতেন কুলুঙ্গিতে বসে। কোন ভগবান খাঁটি, কোনটি ভেজাল সেসব ধর্মীয় কুটকাচালিতে না গিয়ে সব রঙের সব দেবতাদের আশীর্বাদ সাপটিয়ে শুষে নিতেন আমার দাদু।  তাঁর শুধু এক ভয় নরকগমন, আর এক সাধ স্বর্গারোহন। 

            সব তীর্থ তাঁর সপূর্ণ।  হরিদ্বার, হৃষিকেশ, কামরূপ, কামাখ্যা, গয়া কাশী কিচ্ছু বাকি নেই। রামকৃষ্ণ মিশন-ভারত সেবাশ্রমে নিয়মিত চাঁদা,  এককালীন টাকা জমা দিয়ে পুরীদেবের কাস্টমার সার্ভিসে নাম রেজিস্ট্রি করে রেখেছেন দাদু। তাছাড়া কুষ্ঠাক্রান্ত ভিখারী, ফুটপাথকালী, বটতলাশিব, প্লাটফর্মশনি, ঝুপড়ীদরগা, বেদখলকারী  শীতলা-মনসাদের দিকে পয়সা ছোঁড়া, পিতামাতাদের আত্মাধারী কাক কুকুর গুৰুজনাদিদের জন্য বাসি রুটিমুড়ি ছড়ানো কিচ্ছু বাকি রাখেন না তিনি।  কালো পিঁপড়েসহ  গৃহদেবতাদের পাতে নিয়মিত নকুলদানা প্রদানে হাড়কেপ্পন দাদু ছিলেন গৌরীসেন দরাজ। 

            আরো আছে। দাদুর পারিবারিক গুরুবাবা বছরে দু-দুবার দাদুর বাড়িতে দেহ ফেলতেন ক'দিনের জন্য।  সাথে আসত একপাল মেদটেপা চেলা, কল্কিসাজানো চামুন্ডা, আর প্রচার টাউট উমেদার। সেদিন তাঁদের সেবার্থে অন্যান্য উপকরণসহ প্রচুর ঘি আর গাঁজা আনতে হতো।  সেই ঘি বাবার মেদরক্ষা আর গাঁজার ধোঁয়ায় তাঁর মগজ-আত্মাটা থাকত আধ্যাত্বিক।  আর এই সব দানধ্যান, ঘৃত-গঞ্জিকা, রামনাম কৃষ্ণনাম বৈদিক প্রক্রিয়ায় পুণ্যে রূপান্তরিত হয়ে দাদুর আত্মাকে করতো টইটুম্বুর।  

           এহেন পূর্ণধার্মিক দাদু সর্ব প্রকার ধর্ম অভিনয় ছেড়েছুঁড়ে ধর্মশৃঙ্খলমুক্ত সাধুপুরুষ হয়ে গেছেন।  আশৈশব বয়ে বেড়ানো ধর্মের আবর্জনার গুরুভার কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে হয়ে গেছেন সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী ভদ্রলোক - সাহসী মুক্তপুরুষ। চিত্ত হয়েছে তাঁর ভয়ভীতিশুন্য। দেবদেবীদের পাত্তাই দিচ্ছেন না আর। একেবারে ডোন্ট কেয়ার ভাব। দশ আঙুলের তের গ্রহরত্ন আঁটানো আংটি, দুই বাহুতে চার চারটে তাবিজ,গলার রুদ্রাক্ষের মালা - সব নাকি তিনি নর্দমায় বিসর্জন  দিয়েছেন প্রবল ঘৃনায়।  তিনি এখন বাগান করছেন, ছবি আঁকছেন, উপন্যাস পড়ছেন, দিদার সাথে সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন ! না, না, "বাবা তারকনাথ", "জয় সন্তোষীমাতা" নয়, - একেবারে সত্যজিৎ-তপন সিনহা, উত্তম-সুচিত্রা,শাহরুখ-কাটরিনা। এমন কি কদিন আগে নাকি দার্জিলিং আগ্রাও ঘুরে এসেছেন সদিদা। 

তীর্থযাত্রা নয় - ট্যুর, ধর্মনিরপেক্ষ ভ্ৰমণ। তাজ্জব কি বাত।  

           দাদুর কথাবার্তা হাবভাবও অন্য রকম হয়ে গিয়েছে।  বেচারা  গুরুদেবের টাউটটা মাসিক তোলা চাইতে আসতে স্রেফ হাঁকিয়ে বলে দিলেন গুরুবাবাকে ভদ্রলোকদের মত খেটে খেতে। গুরুবাবারা নাকি সভ্য লোকেদের মত গতর খাটিয়ে মেদরক্ষা করবেন ! বেচারা দাদুর মাথাটা গেছে একেবারে। মাসকাবারী ঠিকে উড়িয়া দাঁতফোকলা পুরুতটা টিকিতে ফুল গেঁথে,তেলচিটে পড়া মোটা পৈতে দুলিয়ে সাত সকালে আসত ছুটতে ছুটতে। সোজা ঠাকুরঘরে ঢুকে ঠাকুরঘরের গৃহপালিত দেবদেবীদের মুখে ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরনো পানচেবানো লালথুথু ছেটাতে ছেটাতে কি সব দুর্বোধ্য এট্যাং দেহি ওটাং দেহি মন্ত্র বিড়বিড় করে বলেই ঝড়ের বেগে বলে যেত তেনাদের। সবশেষে দাদুর কপালে লাল হলুদের দুরঙা টিপটা লাগিয়ে দিয়েই পড়ি কি মরি করে ছুট লাগাতো সে  পাশের বাড়ির ষাটটার দোকানে ঝুলিয়ে রাখা গণেশকে মালা পরাতে। এখন এ বাড়ির হাতখোলা খদ্দেরটা হয়েছে তার হাতছাড়া। মাসে সাত টাকা আয় গেছে তার কমে।  পলিথিন ব্যাগে বন্দি হয়ে গৃহদেবতাগণ ঠাঁই পেয়েছেন গুমঘরে - বাতিল করা ভাঙা আসবাবের সাথে।  খালি ঠাকুরঘরে দুটো আলসেশিয়ান বাঁধা। দাদুর নতুন পোষ্য - তাঁর নতুন নেশা। 

            কী হতে পারে? বুড়ো বয়সে ভীমরতি, না কোনো দুষ্ট গ্রহের বৈদিক অভিশাপের প্রভাব? কোন কুসংসর্গের ফলও হতে পারে। যেভাবে যুক্তিবাদী ছেলে ছোকরারা মনোবিকারের চিকিৎসা করা শুরু করেছে! হয়তো দাদুর পবিত্র আধ্যাত্বিক পাগলামী সেরে গেছে। কিংবা এও হতে পারে - সারা জীবন খেটেখুটে  জমানো পুণ্য ফিক্সট ডিপোজিট করে মূল পুণ্য বাড়াচ্ছেন সুদ খাটিয়ে। এখন তাঁর অবসরপ্রাপ্ত পেনশনারদের মত নিশ্চিন্ত অলস জীবন। বিনাশ্রমে পুণ্য বেড়ে চলেছে চক্রবৃদ্ধি হারে। সে পুণ্য ভোগ করবেন পরের জন্মে। 

            দিদাও তাই।  বাংলা ক্যালেন্ডার পঞ্জিকায় যত ব্রত আছে (শুধু শিবরাত্রি ছাড়া - কেন না ঠাকুরের আশীর্বাদে তিনি যদি  শিবঠাকুরের মত ড্রাগএডিক্ট হয়ে যান!) সব তিনি পালন করতেন পরম নিষ্ঠায়।  গতবারও দেখেছি মামাবাড়ীতে পৌষমাসের পিঠেপুলি খেতে এসে। সকাল সন্ধ্যা পূজাপাঠ, শঙ্খ ফোঁকা, কপালে সিঁদুর লেপা,ঘন্টা বাজিয়ে দেবদেবীদের ঝিমুনি ভাঙানো  - কিচ্ছু  বাদ  দিতেন না  দিদা।  শরীর মন সদা পবিত্র রাখতে সারাদিন বারে বারে স্নান করছেন, হাত  ধুচ্ছেন, মাজা বাসনগুলোও, বারে বারে মাজছেন, বারান্দায় ছেটাচ্ছেন গঙ্গাজল, উঠোনময় গোবরজল - হাতে তাঁর ধর্মজাত পবিত্র হাজা।  তাঁর দেহ পবিত্রবাতিকতা দেখে অনেকে পুনর্জন্মবাদীরা অনুমান করতেন দিদা বুঝি  আগের জন্মে মেথরানী ছিলেন। তাঁর ধর্মনেশা আর শুচিবাইয়ের ঠেলায় অতিষ্ট হয়ে আমার মামীরা স্বামীপুত্র সহ বেপাড়ায় ফ্লাট বাড়িতে পালিয়ে বেঁচেছেন।  মায়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম যে রান্নাঘরের উপস্থিত বাসন কোসন, ঘরের আসবাবপত্র কিংবা বাগানের গাছ বা বিড়ালটার কাছে  অনুপস্থিত পুত্রপুত্রবধুদের অবিরাম নিন্দা কীর্তনের ফাঁকে পরম নিশ্চিন্তে তিনি দেবসেবা ও পরমগুরু  পতিদেবতার চরণবন্দনা করতেন নিরুপদ্রব খালি বাড়িতে। 

                এহেন দিদা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ষোঢ়শীর মত উচ্ছল। হয়েছেন পতি পরম গুরুর অনুগামিনী জীবনমুখী সহধর্মিনী।  নিজের হাতে অপবিত্র মুরগীর ঝোল রান্না করছেন নাতির জন্য। তাও আবার তাঁর শুচিশুদ্ধ রান্নাঘরে। হয়তো একদিন আমার বাড়ির মত গোমাংসও ঢুকবে সে রান্নাঘরে। ঐ রান্নাঘর শুচিশুদ্ধ রাখা নিয়ে মামীদের সাথে এই গত বছরেরও দেখেছি নিত্য ঝগড়া।  এখন সব অন্য রকম।  দিদার গলার হারে লোকনাথের জায়গা দখল করেছে বাহারী লকেটে ! ফুল পাতা দেবতার সিংহাসন থেকে উৎখাত হয়ে আশ্রয় পেয়েছে টেবিলের ফুলদানিতে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের জায়গায় অপবিত্র নজরুল রবীন্দ্রনাথ সেন্টার টেবিলে। কপালের পুরুষতান্ত্রিক সিঁদুর, হাতের নোয়া শাঁখা, মাথার ঘোমটা সব হওয়া। দুনম্বরী লোকদেখানো বাজারচলতি নারীবাদী নয়,একেবারে যুক্তিবিজ্ঞান সম্মত আধুনিক। বুড়ী কলজের এলেম আছে দেখছি। তবে খুব উল্টোপাল্টা গোলমেলে ব্যাপার। পাঠকদের মনে হবে এ সব বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি। 


- দুই -

- হটাৎ তোমরা এমন পাল্টি খেলে কেন দাদু?

- ধর্মকর্ম সব ছেড়ে দিলাম দাদুভাই। 

- সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তুদিন  কেন?

- অনর্থক পুণ্য করতে গিয়ে একটি মাত্র মানবজীবন হেলায় হারাচ্ছিলাম। দিন গেল বৃথা কাজে হরিনাম ভজে ....  মানে ঐ সব আর কি। বুড়ো বয়সে মনেও থাকে না শ্লোকগুলো। যাই হোক, better late than never, শেষ জীবনে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সব ছেড়ে মনোমধর্ম নিয়েছি। মানুষই আমার দেবতা। দেবপূজার ভড়ং না করে স্বামী বিবেকানন্দের পথ ধরে মানবসেবা, মানবপূজার ধর্ম নিয়েছি। 

- তুমি যে মহাপাপী নাস্তিকদের মত কথা বলছ দেখি। মরার পর তুমি ভিখারী হয়ে জন্মাবে, নরকেও ঠাঁই হবে না তোমার। দেখে নিও। 

- দেখে নেবার সুযোগ কোথায় রে হতভাগা? Dust thou art,  মরার পরে and dust returneth.ধুলায় মিশে যাব আমি মরণের পরে। স্বর্গে বা নরকে গিয়ে  অথবা পুনর্জন্ম লাভ করে কেউ কখনো পাপের শাস্তি পেয়েছে, না পুন্যকাজের পুরস্কার ভোগ করেছে বলে শুনেছিস, না দেখেছিস। সবইতো পুরুত সাধুসন্ত গুরুবাবা ধর্মজীবি পরজীবীদের রটানো  গুজব।  

-এসব অঙ্ক তোমায় কে শেখাচ্ছে দাদু?

- আমার নবগুরু বোস সাহেব। ওনার কাছেই দীক্ষা নিয়েছি আমি।  সাহেবগুরু  আমার চোখ খুলে দিয়েছেন রে ভাই। এতদিন আমি অন্ধ ছিলাম। পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখিনি  এতদিন। তোদের সুন্দরী দিদার রোমান্টিক মুখটাও এতদিন দেখিনি ভালো করে। ভুবনের আনন্দধারা উপভোগ করিনি।  এখন যৌবনের দিনগুলো হারিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে। খুব। যজাতির মত বা আশিতে আসা ভানু ব্যানার্জীর মত যুবক হয়ে আবার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তোর দিদা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না আমার বিয়ে দিতে। প্রেমই করতে দেয় না, তার বিয়ে। 

- কে তোমার সাহেবগুরু দাদু?


- তিন -

-  চা জলখাবার খেয়েছিসতো?

- একগাদা পিঠেপুলি পাটিসাফটা খেয়ে তোমার জন্য বসে আছি। দিদা  বললো তুমি নাকি আজকাল হরিসভায় না গিয়ে মর্নিং ওয়াক করছো, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছ। কিন্তু তোমাকে যৌবনধর্মে দীক্ষিত করলো কে?

- তা হলে প্রথম থেকেই বলি।  নতুন ট্যাক্স অফিসার জেলায় জয়েন করেছেন শুনে অন্য উকিল যাবার আগে তড়িঘড়ি সাহেবের বাংলোয় ছুটে গিয়েছিলাম। সাথে নিয়েছিলাম ঘোষ সুইটস থেকে কেনা একটা বিশাল সন্দেশের প্যাকেট, আর এক বোতল মোরব্বা আর তোদের দিদার ঠকুরবেদীর কিছু ফুল বেলপাতা। প্যাকেটগুলো ভক্তিভরে টেবিলে রেখে নমস্কার করে বললাম "আপনি এ জেলায় এসেছেন শুনে বাবা বক্রেশ্বরের প্রসাদ নিয়ে এলাম আপনার নাম পুজো দিয়ে। আর সিউড়ির বিখ্যাত মোরব্বা। খেয়ে দেখুন। "

 - ওসব প্রসাদ আমার চলে না উকিলবাবু, আমি ঘোর নাস্তিক। অযথা আপনাদের ঠাকুরদেবতাদের চাটুকারিতা খোশামোদ করে সময় নষ্ট করি না। ওগুলো আপনি ফিরিয়ে নিয়ে যান। নাতিপুতিদের খাওয়ান ওগুলো। 

বললাম," কি বলছেন স্যার, এসব বাক্য উচ্চারণ করা পাপ। এখানকার বাবা বক্রেশ্বরের আর তারাপীঠের তারা মায়ের মহিমা বোধ হয় আপনি জানেননা স্যার। কোনো সাহেব এনাদের আশীর্বাদ না নিয়ে এ জেলার চেয়ারে বসেননি কখনো।  

- বেচারাদের জন্য ভীষণ দুঃখ হয় আমার। এতো কষ্ট করে আপনারা ধর্মাচরণ করে পুন্য  করছেন,, আর আর তার সুফল ভোগ করবেন আপনাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত অনাত্মীয় কোন একজন মানুষ যে এখনো জন্মায়নি এ পৃথিবীতে। 

- বুঝলাম না স্যার,একটু খোলসা করে বলুন।  

- আপনার পার্থিব শরীরে দেহ ও মন ছাড়াও একটা ২১ গ্রাম ওজনের প্রাকৃতিক অঙ্গ আছে বলে আপনি বিশ্বাস বা অনুমান করেন।  আপনার দেহ ও স্নায়ুতন্ত্র চালিত মন নশ্বর। সেগুলো আপনার মৃত্যুর পরে ধংশপ্রাপ্ত হয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু শাস্ত্রকল্পিত সেই আত্মাটা অবিনশ্বর। দেখা যাচ্ছে আপনার অনুমিত আত্মাটার কোন মনও নেই, আবার স্মৃতিও নেই। তার প্রমাণ হচ্ছে আপনার শরীরের কোনও এক অনাবিষ্কৃত অংশে আপনার অনুমিত আগের জন্মের  মৃত ব্যক্তির আত্মা সাঁটানো আছে সে অঙ্গটি আগের জন্মের সব কিছু ভুলে গেছে। আর এক বার বলি, আগের জন্মে যে মৃত ব্যক্তিটির দেহে যে আত্মাটি বাস করতো তার কথা আপনার মনে নেই। 

- মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে আমার আপনার কথা শুনতে শুনতে।  

- বিষয়টা যে খুবই জটিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমার ভাষার দারিদ্রের কারণে আমিও হয়তো ঠিকমত ব্যাখ্যা করতে পারছিনা। এবার আর একবার  আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলি। আমার তথাকল্পিত আগের জন্মে যে অজানা মৃত ব্যক্তির দেহে আমার আত্মাটা বাস করতো, সে ব্যক্তির কথা আমার বা আমার আত্মাটার কিচ্ছু মনে নেই। আপনাদের বাপ দাদারা শিশু বয়সেই  তাঁদেরও পূর্বপুরুষ থেকে বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ধ্যান ধারনার ছাঁচ  আমার আপনার সবার অপরিনত কাঁচা মনে ছেপে দিয়েছেন গায়ে কাদামাটিতে টেরাকোটা চাপানোর মত। ছাঁচে ছাপা সেই সনাতনী মৌলবাদী ধ্যানধারনা স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছে মননহীন,যুক্তিহীন, প্রশ্নহীন পরিবর্তনভীরু নিশ্চল অলস স্থবির মনে। আমার মত অল্প কিছু কৌতূহলী সাহসী মানুষ নরকের ভয় না পেয়ে মনন করতে করতে নিজের নিজের মনের সেইসব আবর্জনা ধুয়ে মুছে সাফ করতে পারে। যারা তা পারেনা তারা মনে করে মৃত্যুর পরে দেহ মন ধংস হলেও আত্মা অমর অবিনশ্বর। তারা ভাবে সেই আত্মা ঈশ্বরের অর্থাৎ পরমাত্মার অংশ। কোন অজ্ঞাত কারণে ঈশ্বরের সেই অংশ অর্থাৎ আমার আত্মাটাকে পুন্যপুষ্ট করার গুরু দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে, এবং এও ধরে নিচ্ছি যে আমার শরীর ও মন তার কাজকর্মের দ্বারা ঐ আত্মাটাকে পাপে বা পুণ্যে পুষ্ট করে, এবং সেই পুষ্টি অনুযায়ী আমার মৃত্যুর পর আমার আত্মাটা পরজন্মে ফলভোগ করবে অথবা অদৃশ্য কোনো একটা স্বর্গে বা নরকে যাবে। এইতো আপনাদের বিশ্বাস?

- এটা শুধু নিছক বিশ্বাস নয় স্যার, এটাই পরম সত্য।  সব ধর্মের সার কথা।  এই আধ্যাত্বিক লোভেইতো মানুষ ধর্মাচরণ করে। 

- ঠিক আছে, এবার আমার দিকে মন দিন।  আপনার মত গন্যমান্য মানুষেরা আমায় কত খাতির করছেন। অন্ততঃ খাতির করার ভান করছেন। আপনাদের শহরের সবচেয়ে ধনী পুরুষোত্তম আগরওয়ালাও এই খানিকক্ষন আগে  একটা ঢাউস মিষ্টির প্যাকেট কোনো মিঠাইৰ দোকান থেকে কিনে বাবা বজরংবলীর প্রসাদ বলে ভেট দিতে এসেছিলেন।  আমি কিসে তুষ্ট হবো এই চিন্তায় কুল পাচ্ছেন না আপনারা। আমি থাকি বিনি ভাড়ার বাংলোয়, জনগণের পয়সায় তেল পুড়িয়ে ম্যাসাঞ্জোর শান্তিনিকেতন ঘুরে বেড়াই।  ক্ষমতা ও বিলাসের স্বর্গসুখ আমার হাতের মুঠোয়। অথচ আমার মত ধর্মীয় শাস্ত্রসম্মত  পাপী ভূ-ভারতে আর কে আছে? আপনাদের বাবা বা গুরুবাবাদের এক ছিলিম গাঁজাতো দূরের কথা এক বান্ডিল বিড়ি দিইনি সারা জীবনে। শনি কালী লোকনাথ  রামরহিমবাবাদের পাতে  নকুলদানাও দিইনি। বখরি ঈদ খ্রিস্টমাসে মুসলমান ক্রিষ্টান আত্মীয়দের বাড়ীতে নিষিদ্ধ খাদ্য খেয়ে আসি। তবু আমি এত স্বর্গসুখ ভোগ করি কোন বিচারে?

- সে আপনার পূর্বজন্মের পুণ্যফল। 

- ধরে নিলাম তাই। অর্থাৎ আপনি বলছেন যে আমার পূর্বজন্মে যে ভদ্রলোকটি হাড়মাস কালি করে জীবনভোর পৃথিবীসুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত  রেখে যে পুন্য সঞ্চয়  করেছিলেন সেই পুণ্যফল আমি ভোগ করছি।  সে বেচারা কষ্ট করে পুন্য করলো, আর তার ফলভোগ করছে আমার মত মহাপাপী! এতে ঐ ভদ্রলোক, ধরুন ঈশ্বর অক্ষয় ঘোষাল - সে বেচারা কি পেল?

- স্যার, প্রয়াত ঐ অক্ষয়বাবুর আত্মাইতো তার পুণ্যফল ভোগ করছেন আপনার শরীরের মাধ্যমে। 

- মেনে নিলাম আপনার কল্পনা বা অনুমান। ধরে নিলাম আপনার যুক্তি একেবারে খাঁটি বাস্তব। কিন্তু মৃত অক্ষয়বাবুর আত্মা আমার মাধ্যমে তাঁর পুণ্যফল ভোগ করলেও সেই অক্ষয়বাবুর যে এতে কোনো লাভ হয়নি সেটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? তিনিতো আর ম্যাসাঞ্জোর শান্তিনিকেতন বা এই বাংলাবিলাস, আপনাদের দেওয়া ভেটবিলাস উপভোগ করতে পারছেননা। ফাঁক থেকে ভোগ করছে আপনাদের এই বোসসাহেব। গাছ লাগলো একজন,আর তার ফল ভোগ করলো তার অপরিচিত অনাত্মীয় অন্য একটি মানুষ। আমি আমার আত্মার প্রাক্তন মালিক ও পুন্যপুষ্টকারী অক্ষয়বাবুকে কৃতজ্ঞতা জানানোতো দূরের কথা, তাঁকে চিনিই না। 


- এরকম কথাতো জীবনে শুনিনি। একটু ধাতস্থ হতে  দিন। আর একবার আর একটু সরল সহজ করে বলুন স্যার। এরকম ব্যাখ্যা কোনো শাস্ত্রে পড়িনি আগে।   

              - আচ্ছা, ঠিক আছে। কয়েকটা কাল্পনিক উদাহরণ দিই। ধরুন আপনি শীঘ্র আপনার ভগবানের সাথে মিলিত হবার বাসনায় আত্মহত্যা করার জন্য গলায় দড়ি দিলেন। পুলিশ এসে সিলিং ফ্যান থেকে আপনাকে নাবিয়ে  হাসপাতালে নিয়ে যেতে ডাক্তারবাবু 'braught dead' লিখে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন। আর কোন দেরি না করে আপনার দেহ থেকে আপনার চোখদুটো উপড়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ ওটাকে একটি অন্ধ মানুষের চক্ষুকোটরে বসিয়ে দিলেন কোন এক চোখের সার্জন। সেই অন্ধ মানুষটি তখন আপনার চোখ দিয়ে পৃথিবীর স্বর্গীয় দৃশ্য দেখবে। কিন্তু আপনি কিছুই দেখতে পাবেন না। কেননা আপনার অপটিক্যাল নার্ভগুলি সেই অন্ধ বেক্তিটির মাথায় জুড়ে গেছে। সেই একইভাবে  আপনার মৃত্যুর পর স্বামী নিগুড়ানন্দজীর মত কোন আত্মা স্পেশালিস্ট সার্জন ব্রেনডেথের কারণে মৃত কোন এক আত্মাহারা  বেক্তির দেহে আপনার পুণ্যপুষ্ট আত্মাটিকে বৈদিক পদ্ধতির সাহায্যে আপনার দেহের আত্মাকোটরে ঢুকিয়ে দিলেন। সেই মৃত ব্যক্তির মৃতদেহটি আত্মা ফিরে পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠবে। আর আপনার চক্ষু পাওয়া অন্ধ মানুষটির পৃথিবীদর্শনভোগের মত আপনার কষ্টার্জিত পুণ্যফল ভোগ করবে আপনার পবিত্র আত্মার দখল পেয়ে। যেমন আপনার চোখটি অন্ধমানুষটির চক্ষুকোটরে ঢুকে তাকে দৃষ্টিশক্তি দিলেও আপনি কিছু দেখতে পাবেননা, তেমনি আপনার আত্মাটা আপনার পরজন্মের দেহে থাকলেও আপনি অর্থাৎ নবজন্মের দেহটি পাবে লবডঙ্কা। 

             আবার দেখুন, এই যে সব ধনী,কোটিপতি, দুর্নীতিগ্রস্থ মাননীয় নেতা মন্ত্রী,সম্মানীও কয়লামাফিয়া গরুপাচারকারী অথবা প্রণম্য অসৎ চাকরীচোর শিক্ষক ইত্যাদি চোরাকারবারিরা রাজবিলাস উপভোগ করছে, ঠান্ডা গাড়িতে বেড়িয়ে স্বর্গসুখ ভোগ করছে, তাদের আত্মাগুলি নিশ্চই পূর্বজন্মে সফল গুরুবাবা অথবা  আপনার মত পুণ্যাত্মার মানুষের ছিল। সেইসব পূজ্য দেবতাসমান  মানুষদের বিদেহী আত্মা পূর্বজন্ম অর্জিত পুণ্যের প্রভাবে আজ এ জন্মে নেতা মন্ত্রীসুখ, চোরাকারবারীসুখ ইত্যাদী নানা সুখ ভোগ করছে। হতভাগ্য ঐসব আহম্মকদের এত কষ্টের অর্জন করা পুণ্যের ফলভোগ করছে কিনা আমার মত পাপী তাঁদের অপরিচিত মানুষেরা !

          এবার ঐ রাস্তার কুষ্ঠরোগীটির দিকে তাকান, কিংবা কোন জন্মান্ধ বা কোন জন্মবিকলাঙ্গ শিশুটির কথা ভাবুন। কত কষ্ট পাচ্ছে তারা। জীবিত অবস্থাতেই  নরকযন্ত্রণা। অথচ ওরা জন্মের দিন কোনো সুযোগই পায়নি পাপ করবার। ওদের আত্মার পূর্বতন মালিকরা, মনে করুন আমার মত নাস্তিক মহাপাপী কোন বোস সাহেব অথবা পাপিষ্ট চূড়ামনি প্রয়াত হিটলার যত পাপ করেছিল ওদের জীবিত অবস্থায়, তাদের কর্মফল ভোগ করছে ঐ কুষ্ঠরোগীট বা জন্মান্ধ, জন্মবিকালঙ্গ মানুষগুলো! আপনাদের শাস্ত্রীয় অনুমান অনুযায়ী প্রয়াত হিটলারের আত্মা তথাকল্পিত ঈশ্বরদের বিচারে ঐ হতভাগ্য মানুষগুলির শরীরে আশ্রয় পেয়ে শাস্তিভোগ করলেও হিটলার স্বয়ং  কিন্তু কোনও শাস্তি পাচ্ছে না। কি অবিচার!

              তবে হ্যাঁ, যদি আপনি মারা যাবার পর আপনার মন মগজটাও আপনার আত্মার সাথে সাথে  আপনার উত্তরজন্মের মানুষটির দেহে ট্রান্সফার করে দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো আপনার ইহজন্মের পুণ্যফল বা পাপফল আপনিই ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে প্রকৃতি সে ব্যবস্থা রাখেনি। আর আপনাদের পবিত্র শাস্ত্রগুলোও আপনাদের মগজগুলোকে আত্মার মত অবিনশ্বর করে সৃষ্টি করেননি। সাধুসন্তরা আত্মার মত মন অর্থাৎ মগজটাকে শ্রাদ্ধশান্তির সময় দেহান্তরে  চালান করবার ফন্দিফিকির শেখাননি পুরুতঠাকুরদের। মরার পর আপনার তথাকল্পিত অবিনশ্বর আত্মা বেঁচে থাকলেও আপনার মন ও স্মৃতি আর কার্যকরী থাকছে না। অর্থাৎ আপনিও আর থাকছেন না। স্বর্গেও না, মর্ত্যেও না। কেন না আপনার মৃত্যুর সাথে সাথে আপনার মরণশীল স্নায়ুতন্ত্রটি ধংশপ্রাপ্ত হবে। আর আপনার পূর্বজন্মের মন চিন্তা করতে না পারলে আপনার অস্তিত্ব আর থাকে কী করে? আমার বর্তমান মন যদি আমার মৃত্যুর পরেও চিন্তা করতে পারত, অন্তত আমার আত্মাটাও যদি তা করতে পারত, তাহলে আমিই আমার পুন্যকাজের পুরস্কার বা পাপের শাস্তি পেতে পারতাম।  আর তা যে সম্ভব নয় তার প্রমান আমি আপনি  সবাই। কেউই আমরা তথাকথিত তথাকল্পিত  আমাদের পূর্বজন্মের আত্মাধিকারীর স্মৃতির উত্তরাধীকার পাইনি। অতএব আপনার মৃত্যুর পর আপনার পাপ পুণ্যের ফলাফল ভোগ করবার কোন আশা নেই। যান, মরে যাবার আগে বাড়ি গিয়ে বুড়িকে নিয়ে নাইট শো দেখে আসুন। 

- চার -

            সেদিন বাড়ি ফিরে সারারাত এতটুকু ঘুমাইনিরে দাদুভাই।  মনে হলো ধম্মকম্ম করতে করতে আমার মনুষ্যসুলভ যুক্তিবাদী স্বত্বাটি (rationalist) আমার মনের অজান্তে উবে গিয়ে ধর্মময় হয়ে গেছে। যুক্তিবাদী মন হারিয়ে আমি আর মানুষ নেই। মননহীন পশু হয়ে গিয়েছি। সাহেবের কথাগুলো ভাবছি আর ঘামছি। চোখে নিদ্রা নেই। তোদের দিদাকে সব কথা বললাম খুলে। তখন তারও আমার মত সেই একই অবস্থা। 

             ভোর রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।  হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল  একটা কুস্বপ্ন দেখে।  স্বপ্নে দেখলাম আমি মরে গেছি। আমার দেহটাকে মর্গের থেকে নিয়ে যাবার আগে গবেষণার জন্য বৈজ্ঞানিককে দেখি এক ডাক্তারবাবু আমার মগজ বা মনের কলা, অর্থাৎ পুরো স্নায়ুতন্ত্রটা গোপনে একটা বোয়ামে রেখে দিলো অ্যালকোহলে চুবিয়ে। তবে আমার আত্মাটাকে কব্জা করতে পারল না সে। ফুড়ুৎ করে উড়ে মর্গের ঘুলঘুলি দিয়ে  পালিয়ে গেলো সে আত্মাটা। সেঁধিয়ে গেল সেটা আমার জন্মশুত্রু রামহারামী ফিরোজ উকিলের পুত্রবধূর পেটের ছেলেটার দেহে।  বাকি দেহটা তোদের মামারা 'বলহরি বলহরি' বলতে বলতে চলতে লাগলো নিমতলার দিকে। কিন্তু  তখনও আমি, মানে বোয়েমে রাখা আমার মনটা সব ভাবতে পারছে পুরান  জীবনের কথা। দেখলাম সে হতচ্ছাড়া আমার আত্মধারী ম্লেচ্ছ নাতিটা আমার পুণ্যাত্মার দখল পেয়ে সুন্দর চেহারা, স্কুল কলেজের পরীক্ষায় সুন্দর ফল, লটারির পুরস্কার, আমার বাঁধা মক্কেল, মদের দোকানের লাইসেন্স - সব কিছু হাতাচ্ছে। অকৃতজ্ঞ অব্রাহ্মণটা  আমাকে একটা ধন্যবাদও পর্যন্ত দিচ্ছে না। ম্লেচ্ছ নাতিটার ব্রাহ্মণ আত্মাটা গায়ত্রীমন্ত্র  ভুলে আল্লা আকবর বলে আজান দিচ্ছে গলা ফুলিয়ে। কেমিক্যালে ডোবানো আমার মন-আমার মগজের সাহায্যে বোতলের কাঁচের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম সব। 

              ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে ঘুম ভেঙে ভাবতে লাগলাম আকাশ পাতাল। আমৃত্যু এত কষ্টে তিল তিল করে জমানো পুন্যগুলো সব ভোগ করবে কিনা ফিরোজ উকিলের নাতি! আমার ডজন ডজন বাঁধা মক্কেলগুলো ওর চেম্বারে লাইন মারবে ! কোভভি নেহি।  সেদিন থেকে সব ছেড়েছি।  এখন আমার স্বর্গের লোভ নেই, নরকের ভয়ও নেই। আর তাই ধর্ম করার দরকারও নেই।  আমি এখন ধর্মশৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন সাহসী মানুষ।  

বইমেলা -
অশোক দাস চার্বাক
Nov. 26, 2024 | সমাজ | views:882 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বাবাগাধা - ছি ছি ছি!! তুই কিনা গাধার ব্যাটা হয়ে এ কথা বললি মুখ ফুটে? জিভে আটকাল না একটুও! ছি! কোনও গাধাকে কোনও যুগে কেউ বইমেলায় যেতে দেখেছে, না কোনও গাধাকে কেউ বই চিবোতে দেখেছে। গাধা জাতের নাম ডোবাবি দেখছি আহাম্মক গর্ধব কোথাকার। এর পরে তো অল্পবয়সী তোর গাধা বন্ধুরা 'হাঁদাগাধারাম' বলে তোকে ৱ্যাগিং করবে। হাঁট-হাঁট, নইলে এক্ষুনি মধু ধোপার চাবুক খাবি। 


ছেলেগাধা - কেন বাবা, গাধারা বইমেলায় যায় না কেন?

বাবা- দরকারই হয় না। গাধারা হচ্ছে সবজান্তা। গাধাদের 'ব্যাদে' সব লেখা আছে। গাধাদের সে গর্ধববেদ পড়তেও হয় না কখনও। মেঘনাদ সাহা নিজে এ সার্টিফিকেট দিয়েছেন সব জন্মসিদ্ধ গাধাদের। গাধারা হচ্ছে ভূ-ভারতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজাতির প্রাণী। বামুনদের মত ভগবান ব্রহ্মার মাথার ঘিলু থেকে তাদের জন্ম।  পরশ্রীকাতর নিম্ন প্রজাতির  মানুষরা লজ্জায় তা স্বীকার করে না বটে, তবে আমাদের প্রাচীন জন্মসিদ্ধ সাধুসন্ত মুনিঋষিরা এ কথা বলে গেছেন। আর আমাদের বাপ ঠাকুরদা চোদ্দোপুরুষেরা বংশ পরম্পরায় এ 

সনাতন কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে এসেছে। গাধাদের শাস্ত্রবাক্য, গাধামুনি ঋষিদের বেদবাক্য তো আর মিথ্যে হতে পারেনা। অনর্থক বই পড়ে নতুন জ্ঞান অর্জন করা যে কতটা নিরর্থক সেটা সব গাধারাই জানে। 


ইচ্ছে হলে অন্য যে কোনও মেলায় যা। কোনও ভদ্রলোক গাধা ও নিয়ে কিচ্ছু বলবে না। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চেপে পৌষমেলায় যা। সেখানে নরম নরম কচি কচি ঘাস দিয়ে তৈরী থালা, বাটি, ঠাকুরদেবতার পুতুল পশু প্রাণীদের আদলে তৈরী নানা আর্ট ওয়ার্ক চিবিয়ে চিবিয়ে খা। গরম গরম জিলিপি খা। বুঝিস বা না বুঝিস, মাইকে রবীন্দ্র সংগীত শুনে হিন্দী গানে নাচতে নাচতে বড় মুখ করে বাড়ি ফের। নিজেকে বেশ ইন্টেলেকচুয়াল গাধা মনে হবে। 


বন্ধুদের কাছে বড় মুখ করে বলতে পারবি রবীন্দ্রতীর্থ ভ্রমণের উপাখ্যান। সে পুণ্যে মরার আগেই তোর আত্মার শান্তি হয়ে যাবে। মহাপাপীর ছেলেদের মত বিজ্ঞাপন দিয়ে আত্মার শান্তিকামনা করতে হবে না। বোকা শ্রাদ্ধশান্তিও করতে হবে না পুরুত ডেকে। শিল্পমেলায় যা-বাহারি দু’একটা ভোগবিলাসের জিনিস কিনে মনে আনন্দ পাবি। জিনিসগুলোর জন্য তোর গর্ব আর পড়শীর ঈর্ষা হবে। বড় সুখ হবে তোর মনে। খাদ্য মেলায়ও যেতে পারিস। সেখানে নানা দেশের ঘাস বিচালি খেয়ে আস্তাবলে শুয়ে শুয়ে জাবর কাট মনের সুখে। অপার আনন্দ পাবি মনে। ঋণ মেলায় ব্যাংকের টাকা ধার করে শোধ না দেবার মতলব কর। দাদা দিদি নেতা মন্ত্রীদের কাটমানি দিয়ে হাতে রাখতে পারলে কেউ তোর টিকি ছুঁতে পারবে না। টাকা চুরির অনাবিল আনন্দ পাবি মনে। বিবাহ  মেলায়ও যেতে আপত্তি নেই। মনের মত একটা ইউজ এন্ড থ্রো বউ ধরে নিয়ে আয় ওখান থেকে। সারাজীবন না হোক বছরখানেক until the day of divorce বেশ ফুর্তি করতে পারবি।  সাগর মেলায়ও যেতে পারিস।  সেখানকার নোনতা জলে গোলা দৈব ডিটারজেন্টে বছরভর করা সব পাপ কেচে কুচে সাফসুতরো করিয়ে আয়। আহা, মুখ শুকনো করছিস কেন? পাপের ফল, মানে ঐ কালো টাকা-ফাকাতো আর সাগরজলে ধুয়ে যাবে না। শুধু পাপটুকু। ওগুলো গা থেকে মুছে আবার নবোদ্যমে বিধবা লতাপিসির বাগানের শাকসবজি খেয়ে পাপ করা শুরু করে চালিয়ে যা পরের পুণ্যস্নান পর্যন্ত। সাধুসাজা চতুর মানুষেরাও এসব পুণ্যকর্ম করে। কেউ এ জন্য গালমন্দ করে না। দু’একজন বোকা গাধা ছাড়া সব বুদ্ধিমান কৃতী গাধারাই সে সব পাপ করে পেট মোটা করে। 

             

যে কোনও মেলা থেকে ফেরার পথে মনে একটা অনাবিল আনন্দ পাবি। কিন্তু বইমেলা! দূর দূর দূর! দু-চারখানা সস্তা বই, কিছু লিটল ম্যাগ আর ব্যাগভর্তি ক্যাটালগ নিয়ে যখন মেলার গেট পেরিয়ে বাইরে আসবি, তখন তোর মন একেবারে শুকনো মরুভূমি হয়ে যাবে। আত্মা পাথর। তখন শুধু মনে হবে মেলায় কত্তো বই আর ট্যাঙ্কের টাকা কত কম। মোট বওয়ার ফাঁকে মেলায় গেলা বইগুলো জাবর কাটার সময় মনে হবে - হায় আমি কত কম জানি।  অন্য মেলায় গিয়ে পেটভরে, মনও ভরে। আর এ মেলায় পাবি শুধু দুঃখের সমুদ্র। এখানকার ক্ষুধা সর্বগ্রাসী। বইয়ের খিদে কখনো মেটে না। যত কিনবি তত কিনতে ইচ্ছে করবে।  কেঁদে কেটে কুল পাবি না একেবারে।  


গুরুজনেরা বলেন বড় সাংঘাতিক দ্রব্য ঐ বই। সর্বদুঃখের কারণ। পশুপ্রাণীদের মানুষই সবচেয়ে দুঃখী। কেন জানিস? বই, মানে যাকে বলে গিয়ানের খনি। সেই জ্ঞানবৃক্ষে ঝুলে থাকা নিষিদ্ধ ফলগুলো যেদিন হতভাগা মহাপাপী মানুষেরা বোকার মত খাওয়া শুরু করল সেদিন থেকেই শুরু হল ওদের দুঃখের ইতিহাস। যে যত বই পড়েছে, যে যত জ্ঞানী হয়েছে সে তত অজ্ঞান অশিক্ষিত বলে নিজেকে ভাবতে শিখেছে। 

এটাকে ডাক্তারী ভাষায় বলে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। সক্রেটিস থেকে শুরু করে নিউটন সব লেখাপড়া জানা মানুষেরা নিজেদের অজ্ঞান ভেবে সারা জীবন দুঃখকষ্টে কালাতিপাত করেছে। সারা জীবন আরও আরও জ্ঞান চেয়ে হ্যাংলার মত কাঙাল হয়েছে।  

                

বইমেলায় গেলে তোকেও ওই মারণ রোগে ধরবে। কথায় বলে, বইয়ের নেশা সর্বনাশা। ড্রাগের মত। একবার ধরেছ তো ভবিষ্যত অন্ধকার। ফতুর করে ছেড়ে দেবে ক্যান্সার রোগীর গরীব ছেলেমেয়েদের মত। 

                  

তবে হ্যাঁ, ধর্মীয় বইয়ের কথা আলাদা। সেগুলো গাধারা দুলে দুলে চিবিয়ে চিবিয়ে বেশ খায়। কিচ্ছু অর্থ বুঝতে হবে না, শুধু গলায় ঢুকিয়ে মুখস্ত করে বইগুলো গিললেই হবে। জাবরও কাটতে হবে না হজম করার জন্য। অথচ তোর মনে একটা সবজান্তা আধ্যাত্মিক ভাব জন্মাবে। গাধাদের মধ্যে যারা গুরুবাবা হয় তারা আবার ওই সব বইয়ের গালগপ্পের কোর্টেশন সহ ভক্তদেরকে বাণী শুনিয়ে খুব খাতির পায়। মোট বয়ে চাল কলা ঘাস বিচালি আয় করতে  হয় না তাদের।  যে সব গাধাদের একটু কম বুদ্ধি তাদেরকে স্বর্গের লোভ আর নরকের ভয় দেখিয়ে তাদের মুখ থেকে কচি ঘাস কেড়ে খায় মহানন্দে। আর হদ্দগাধা ঐ বোকা গাধারা নিজেরা অভুক্ত থেকে চতুর গুরুবাবা পুরুতবাবাদের পেট মোটা করিয়ে পুণ্যি  অর্জন করে। যা, রাস্তার ওপারে গাছের তলায় বসে থাকা তেল সিঁদুর মাখা পাথরটায় তোর সামনের পায়ের ক্ষুর ঠুকে প্রণাম করে আয়। পরকালের জন্য পুণ্যি হবে। আজকে বেশি ঘাস দেবে মধু, মরার পর স্বর্গে যাবি। 


হ্যাঁ, যে কথাটা বলছিলাম। এই যে বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ। এ দেশে এমন হাড়-হাভাতে দৈন্যদশা কেন জানিস? কবিতা, গল্প, আড্ডা, আর ঐ বইপড়ার নেশা। ঐ নেশাটাই বাঙালি জাতটাকে একেবারে দেউলিয়া করে ছেড়ে দিয়েছে। কর্মবিমুখ। এখানকার লোকেরা বোঝে না যে, যে সময় অনর্থক বই পড়বি সে সময় একটু বেশি করে মোট বইলে মধু ধোপা একটু বেশি ঘাস বিচালী ওভারটাইম দেবে।  দেবে কিনা? সেই অমূল্য সময় হেলায় অপব্যয় করে তোরা যদি কবিতা উপন্যাস আর বস্তাপচা যুক্তিবাদী দর্শন পড়িস কেউ তোকে খেতে দেবে? দেবে না। এই ওয়ার্ক কালচারটা তোরা যদি না বুঝিস গাধাদের জিজ্ঞেস করলেই তো পারিস। অথবা আমাদের জীবনযাপনের বৈজ্ঞানিক কৌশল শিক্ষা নকল করতে পারিস। কেন না আমাদের জীবনই আমাদের বাণী।

                   

উন্নতি নাই তাই ঐ বই নেষুড়ে  মানুষদের।  যারা বই লেখে তারা আরও হতভাগা। যেমন ধর মাইকেল। মেঘনাদ না লিখে যদি বাপের জমিদারিটা দেখতিস, তাহলে পায়ের ওপর পা তুলে কত সুখে কত বেশিদিন বাঁচতিস। তা না করে কাব্য লিখতে গেলি। তাও আবার উল্টোপাল্টা রামচন্দ্র বিরোধী কাব্য। কি লাভ হলো তাতে? ধারদেনা করে অকালে অক্কা পেলি, বৌ পালালো, ছেলে মরল। শেষ বয়সে  'কি ফল লভিনু হায়' বলে মাথা চাপড়ালি। আবার দেখ না, রুশদি নাসরিনদের। কী দরকার ছিল হাবিজাবি লেখবার? খাওয়া পরার তো অভাব ছিল না তোদের। বাড়িতে কোরান, বাইবেল, গীতা, ব্রতকথা, পুরাণেরও অভাব ছিল না দুলে দুলে পাঠ করবার জন্য। বাপেদের পয়সাও ছিল, আবার নিজেদেরও এলেম ছিল পয়সা রোজগারের। ঐ হাবিজাবি বই লেখার জন্যই তো আজ তোরা ঘরছাড়া, দেশছাড়া হয়ে ধার্মিকদের ছুরি, গুলি খাবার ভয়ে পথে পথে ছুটে বেড়াচ্ছিস। এবার বুঝলি ব্যাটা কেন বইমেলায় যাবি না। বইয়ের নেশা মারাত্মক। নতুন বইয়ের গন্ধেও নেশা ধরায়। তাই বুদ্ধিমান গাধারা কখনো বই পড়ে না, বইমেলার ধার দিয়েও যায় না।  

                    

মানুষগুলো কী বোকাবুদ্ধু দেখ। গর্ধবের এক শেষ। হাজার হাজার বছর ধরে ভেবে, কোটি কোটি বই লিখে, দেশ বিদেশের সভা সমিতিতে সেমিনার করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস লিখে এখনও তারা ঠিক করতে পারল না তারা কী খাবে, কী পরবে, কী ভাবে শোবে, কী ভাবনা ভাববে, আমাদের মত ফুল উলঙ্গ থাকবে, না নটনটীদের মত হাফ উলঙ্গ থাকবে, কী ভাষায় কথা বলবে, কোন সুরে গান গাইবে। শুধু রাশি রাশি বই লিখেই চলেছে। সুস্বাদু নরম কচি কচি ঘাসবিচালী পচিয়ে কাগজ বানাচ্ছে, আর সেই কাগজে হাবিজাবি ছাপছে। কিন্তু এত করে ঐ রামগর্ধব মানুষের দল কোনও কিছুর কুল কিনারা করতে পেরেছে? পারেনি। মনে শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। তার উত্তর পেল তো সেটা আবার আর একটা প্রশ্ন হয়ে গেল। সেই নবজাত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আবার হয়রান। এর শেষ নেই। অনন্তকাল ধরে এই ট্র্যাডিশন চলছে মানুষদের মনে।  

                       

কিন্তু প্রকৃতির সেরা সৃষ্টি গাধাদের দেখ। সেই কোন যুগে গাধাদের মুনি ঋষি সাধু সন্তেরা কত সহজে সব কিছু তাঁদের গর্ধব পুরাণ, গর্ধব শাস্ত্রে, গর্ধব উপনিষদে ঠিক করে দিয়ে গিয়েছেন। সেগুলোর নির্দেশ একেবারে ধ্রুব সত্য। ধ্রুব নক্ষত্রের মত স্থির, নিশ্চল। পরিবর্তন সংশোধন কিচ্ছু করতে হয় না গবেষণা করে। ঠিক কি ভুল বিচার করতে হয় না।  লাখো লাখো বছর আগে একটা গাধা যা ভেবেছে, যা খেয়েছে, সারা পৃথিবীজুড়ে যে ভাষায় কথা বলেছে, যে সুরে গান গেয়েছে, আজও সারা পৃথিবীর তাবৎ গাধারা সেই একইভাবে চলছি, একই সনাতন ধর্ম বিশ্বাসের সাথে পালন করে চলেছি। ভাষা, চিন্তা, ধর্মের বা জীবনযাপনের কোনও ভেদাভেদ মতভেদ নাই গাধাদের মধ্যে। সনাতন ধর্মের কোনও পরিবর্তন, কোনও সংশোধন এমেন্ডমেন্ট কিচ্ছু করতে হয়নি। সারা বিশ্বের সমস্ত দেশের সমস্ত গাধার সনাতন চিন্তারও কোনও ভেদাভেদ নেই। বাঙালিগাধা-ইংরেজগাধা, হিন্দুগাধা-মুসলমান গাধা বলে কোনও কৃত্রিম ভেদাভেদ নেই।  গাধাদের সেই সুপ্রাচীন বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহ্য মহান। আমরা মনে করি "বাসুধৈব কুটুম্বকম", সারা দুনিয়ার সমস্ত গাধারা পরস্পর আত্মীয়, পরস্পর ভাই।  আমরা 'ওরা' 'আমরা' ভেদ করি না। বলি না"। তাই আমরা গর্বের সাথে বলি "আমরা গাধা " 

                     

আস্তে চলার জন্য এই যে চাবুকটা খেলি পিঠে, তার জন্য তোর মনে কি কোনও কষ্ট হলো? পিঠটা দু’মিনিটের জন্য সামান্য জ্বলে গেলেও মনে কোনও কষ্ট হয়নি। বুদ্ধিমান গাধাদের মনে কোনও কষ্ট হয় না। কেন জানিস? কেন না আমরা জানি দুনিয়ার নিয়ম অনুযায়ী এটা আমাদের প্রাকৃতিক পাওনা। আমাদের পূর্ণগর্ধব ধর্মগুরু একশোআট শ্রী মহাগাধানন্দ বলেছেন এটা আমাদের বিগত জন্মের পাপের ফল। প্রেমময় ঈশ্বরের অপার করুনা। এতে দুঃখ বেদনার কি আছে। একটু পরে ঘাটে পৌঁছে গেলেই তো কাপড়ের গাঁটরি নাবিয়ে নিয়ে আমাদের ছেড়ে দেবে ঘাস খেতে। আমরা তখন স্বাধীন।  

                   

কিন্তু মানুষকে দেখ। ওরা বইতে পড়েছে যে ফ্রান্স রাশিয়া চীনে দক্ষিণ আফ্রিকায় নাকি বিপ্লব হয়েছে। লন্ডনে মানবাধিকার আন্দোলন হচ্ছে। তুই যদি মূর্খ  মানুষদের ঐসব বই পড়িস তোরও তখন চাবুক খাওয়ার জন্য দুঃখ হবে, রাগ হবে। মন প্রতিবাদ করতে চাইবে। গর্ধবাধিকার কমিশন বসানোর দাবিতে ইনকিলাব করতে ইচ্ছে করবে। অশান্তির একশেষ হবে। তুই তখন মরবি। 

 তাই বলি, বইমেলার ধরে কাছে যাবি না। মানুষদের বোকা বোকা রোগ ওসব।  মরুক ব্যাটারা বইমেলার ধুলাবালি খেয়ে।  আমরা গলায় দড়িঘন্টি বেঁধে টুং টাং করতে করতে দুর্লভ গর্ধব জীবন উপভোগ করি। মালিকের দেওয়া ঘাসবিচালী খাই আর গলা তুলে দু’পা উঁচু করে গাধা প্রজাতির জীবনমুখী গান গাই। চল, হাঁট। 

সমালোচনা: সম্পাদক অথবা 

asokdas.godless@gmail.com/ asokdas1943@gmail.com 

ঠাকুমার স্বর্গলাভ -
অশোক দাস চার্বাক
Nov. 25, 2024 | ছোটোগল্প | views:296 | likes:2 | share: 2 | comments:0

প্রাতস্নান সেরে, গরদের থান পরে, মুখে একটা ভক্তি ভক্তি ভাব মেখে শয়তানের ঠাকুমা নিস্তারিণীদেবী সেই কোন কাকভোরে ঠাকুরঘরে ঢুকেছিলেন। বেদীতে সাজানো কয়েকটি বহুল প্রচলিত দেবদেবী, জনপ্রিয় মহাদেব, নানা রঙের মাকালী, কালো কৃষ্ণ, ফর্সা কৃষ্ণ, শনি মনসা ইত্যাদি  প্রাচীন  ঠাকুরদেবতাদের ছবি, আধুনিক সন্তোষী মা, অবাঙালী বজরংবলী, বিদেশি যীশু, বুদ্ধ, গড়গড়া সেবনরত মিষ্টি মিষ্টি করে হাসা মেদবহুল সবে দেবত্ব পাওয়া প্রেমময় গুরুদেব ইত্যাদি গুনে গুনে ছাব্বিশটি ফুল দেবতা, হাফদেবতা, কোয়াসি দেবতা, সব প্রজাতির দেবদেবী ও ভক্তদের দ্বারা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপিত উঠতি গুরুবাবা ভবিষ্যতের দেবতার ছবিগুলিতে একটি একটি করে মালা পরিয়ে এক এক করে পুজো সেরে প্রশান্ত মুখে এতক্ষনে বেরুলেন তিনি পাক্কা দুই ঘন্টা পরে। পাপের ভয়ে বেদীতে নিরাকার আল্লার ছবি না থাকায় তাঁকে মনে মনে নমস্কার করেছেন। কোনও ঝুঁকি নেননি তিনি। স্বর্গপ্রাপ্তি নিশ্চিত। হাতে তাঁর পাথরের থালায় কিছু নকুলদানা ও ফুলবেলপাতা। এ বাড়ীর সবার হাতে একটি করে নকুলদানা প্রসাদ দিয়ে তাদের মাথায় ফুল বেলপাতা ছোঁয়াবেন কপালে প্রদীপের তাপ দিয়ে। সারাদিন ভালো থাকবে সবাই। কোনো কাজে বিঘ্ন হবে না কারো। 

         ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়েই ৫-৬ বছরের নাতি শয়তানের সাথে দেখা।  শয়তান বলে উঠলো, - "এতক্ষন ঠাকুরদেবতাদের তেল মেরে কি আদায় করলে ঠাকুমা?"

- ছোটোকাকার কাছে এইসব শিক্ষা হচ্ছে, না? ছিঃ এত বড় বাড়ীর ছেলের মুখে কিনা এমন সব অসংসদীয় অভদ্র অভদ্র ভাষা! এরকম কথা আর বলো না। 

- তাহলে বল ঠাকুরের কাছে কি চাইলে তুমি। নিশ্চই একটা ধান্দা আছে।    

- কিচ্ছু চাই না ভাই, শুধু ঠাকুরের শ্রীচরণে একটু আশ্রয় চাই। 

    - কেন, তুমি কি রাস্তায় থাক, তোমার কি আশ্রয় নেই নাকি?

    - তা, থাকবে না কেন। তবে সারা জীবনে তো অনেক পাপ করেছি, পরকালের জন্যও তো কিছু করতে-টরতে হবে। 

    - পাপের ফল তো তুমি পাবেই। পুজো করলেও পাবে, না করলেও পাবে।  ঠাকুররাতো নেতা মন্ত্রী বা সরকারী অফিসার নয় যে তেল/ঘুষ খেয়ে, প্রকৃতির নিয়ম ভেঙে তোমার সব পাপ মকুব করে দেবে।  আর মরার পরে দেবে স্বর্গে একটা দক্ষিণ খোলা ফ্লাট বা বাংলো। 

      - (স্বগতোক্তি: এ সব হচ্ছে  অজিতের  শেখানো বুলি। তোতা পাখীর  মত মুখস্ত করেছে কিচ্ছু না বুঝে।) আর পাকামো করতে হবেনা তোমায়। ছোট তুমি, ছোটর মত থাকবে।  বড়দের কথা শুনবে।  

      - ছোটকাকুও তো বড়, আমিতো ওর কথা শুনি। চার্বাকদাদুর কথাও শুনি। 

      - আবার তক্কো। নাও, প্রসাদ নাও। 

      - ই: রোজ রোজ শুধু নকুলদানা! তোমার কেষ্ট আর গুরুবাবদের যে ডায়াবিটিস হবে।  মাটনরোল, চিকেন বিরিয়ানী, বিফ কাবাব, চকোলেট, আইসক্রীম - এসব দিতে পারোনা? 

       - আবার আজবাজে কথা। ঠাকুরদেবতারা কি এসব খাবার খান?

       - কি খান তুমি জানলে কি করে? ছোটকাকু বলেছে যে, যারা ঠাকুর দেবতা, শাস্ত্র টাস্ট্র ফেঁদেছিলো তারা নিজেরা যা খেত তাইই ঠাকুরদেবতাদেরকে দেবার ব্যবস্থা করে গল্প লিখে গেছে। আসলে তখনতো আর চাউমিন, নোডলস, ফুচকা টুকচা ছিলো না। তাহলে দেখতে তাদের অন্য রকমের মেনু বানাত কবিরা। এতদিনে মডার্ন ঠাকুরদেবতারা নিশ্চই আমাদের মত ফুড হ্যাবিট পাল্টিয়েছে। রিমোর্টে না খেয়ে কাঁটা চামচও ব্যবহার করছে।  তাঁরা এখন তোমাদের ওই সেকেলে খাবার ছুঁয়েও দেখেন না। তুমি ওদের জন্য ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করো। আমার ভালো লাগেনা ওদের পচা পচা প্রসাদ খেতে। ওনারাতো সর্বভুক, যে যা নৈবেদ্য দেয় বিনা প্রতিবাদে খান। নররক্ত  নরমাংসও খান নরবলির পর। ওনাদের মেনু পাল্টাও তুমি।  

                 কানে হাত দিয়ে ঠাকুমা বলে উঠলেন, "ছি ছি, এসব কথা শোনাও পাপ। ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে এসব কি রকম কুৎসা! তোমার মাথাটা একেবারে চিবিয়ে খাচ্ছে  ঐ অজিতটা।  যাচ্ছি তোমার বাবার কাছে।  একটা বিহিত করতেই হবে।"

                  সোজা  বড়ছেলের ঘরে ঢুকলেন নিস্তারিণী দেবী।  রোজকার মত হাতে  একটা নকুলদানা দিয়ে মাথায় ফুল বেলপাতা ছুঁইয়ে বললেন, "ছেলেটা যে অজিতের পাল্লায়  পড়ে গোল্লায় যাচ্ছে সেটা কি তুই দেখেছিস? পরলোকে যে জল পাবিনা ও  ছেলের হাতে।"

                  

শয়তানের বাবা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে নকুল  দানাটা চেবাতে চেবাতে দার্শনিকসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, "সবই ওপরওয়ালার হাত মা, সব তিনিই করাচ্ছেন, তুমি আমি নিমিত্ত মাত্র। শাস্ত্রে লিখেছে।"

           - সেটা অবশ্য আমিও মানি। তবে শুধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী, আর গীতার বাক্যের ওপর  ভরসা করলেতো চলবেনা। নিজের ছেলের ভবিষ্যতের ব্যাপার বলে কথা। চোখ কান খোলা রাখতে হবে সব সময়। বলি শোন, শয়তানের নামে করা মাকালীর জোড়া পাঁঠার মানতটা এবার শোধ দিয়ে দে। মায়ের আশীর্বাদে কেউ ওর মাথা বিগড়ে দিতে  পারবেনা।"

                   বাবা মারা যাবার পর মাতৃদেবী সারাদিন স্বর্গলাভের চিন্তায়/দুশ্চিন্তায় একপ্রকার মানসিক রোগী হয়ে গেছেন ঈশ্বরভক্তদের মত। খুব প্রেম ছিল দুজনের। মরার পর স্বর্গবাসী স্বামীর কাছে যেতে চান।  মাকে খুশি করবার জন্য বড়কত্তা বলে উঠলেন, "কথাটা তুমি মন্দ বলোনি। আমারও তাই ইচ্ছা। অজিতকে বলে কালই পুরুত/জহ্লাদ  ডেকে পূজোর দিন ঠিক করে ফেল।"

                এমন সময় অজিত ঢুকলো ঘরে। বললো,"এতো হইচৈ কেন মা। আমার নামে কি চুকলি কাটছো দাদার কাছে?"

        - হৈচৈ হবেনা! নিজেতো জাতধর্ম  খুইয়ে দেশসেবা ছোটোলোকসেবা করে বেড়াচ্ছো, বাপ চোদ্দপুরুষদের মুখে চুনকালি দিয়ে পৈতেটাও খুলে ফেলে দিয়েছো।  ইহকাল পরকালতো ঝরঝরে।  কিন্তু দুধের ছেলে ভাইপোটাকে নাস্তিক বানাচ্ছিস কেন বলত।  ঠাকুর দেবতাদের বই না শুনিয়ে যত বাজে বই পড়ে শোনাচ্ছিস, আজেবাজে কথা শেখাচ্ছিস, যুক্তিবাদী ক্লাবে বক্তৃতা শোনাতে নিয়ে যাচ্ছিস।  তোদের কুশিক্ষায়  মুখে মুখে তক্কো করতে শিখেছে  আজকাল - আমাদের সাথে এমন শত্রুতা করছিস কেন বলতো, কেন?"

          - ঐটুকু বাচ্চার অপরিণত মাথায় ঠাকুদেবতার বদ চিন্তা ঢোকাচ্ছো কেন তোমরা? কেনইবা ওকে আস্তিক বানানোর চেষ্টা করছো? তোমাদের যেমন অধিকার আছে মনসা শনির পাঁচালী পড়ানোর, আমারও তেমনি কর্তব্য আছে ওকে বুঝিয়ে বলা যে ওগুলো সাহিত্যিকদের কাল্পনিক গল্প মাত্র। তোমার জটায়ু-গরুড়, ব্যাঙ্গমা - ব্যঙ্গমী, সুখ-সারির আজগুবি গল্পের মত। তুমিও ওকে ওর কাঁচা মগজটা ধোলাই করে আস্তিক করার চেষ্টা ছেড়ে দাও, আমিও নাস্তিক করার চেষ্টা ছেড়ে দেব। বড় হলে নিজের স্বাধীন চিন্তায় যেটা ভালো মনে করে করবে। আসলে আমি ডিফেন্সে খেলছি কিনা। তোমাদেরকে আক্রমণ নয়, তোমাদের আবেগে আঘাত করা নয়,আমি শুধু তোমাদের সংস্কারের বিষ থেকে শিশুটাকে বাঁচাতে চাই। আস্তিক্যরোগের ছোঁয়াচের আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে ওকে আস্তিক্যরোগের প্রতিষেধক খাওয়াচ্ছি।  

          - দেখ, সেদিনকার ছেলে তুই, বড় বড় কথা বলিসনা। তুই নাস্তিক, তুই তোর মত নিয়ে থাকিস। আমরাতো কিছু বলিনা।  কিন্তু আমাদের বিশ্বাসে তুই আঘাত দিস কেন? আমাদের বিশ্বাস নিয়ে আমাদের বাঁচতে দে। 

           - তোমাদের গুরু ধর্মপ্রচারকরাও আমার মত অন্যের বিশ্বাসে অন্যের আবেগে আঘাত দিয়েছেন। মোহাম্মদ যীশু থেকে শুরু করে চৈতন্যদেব রামকৃষ্ণ - সবাই।  সমসাময়িক আধমরা সমাজের প্রচলিত আবেগে আঘাত দিয়ে ওনারা যদি অন্যায় না করে থাকেন,আমি কী অন্যায় করলাম? তুমি কি বল বড়দা?

       - তাই বলে বাপ ঠাকুর্দা চোদ্দপুরুষের রীতিনীতি, যুগ যুগ ধরে প্রচলিত সনাতন ধর্ম বিসর্জন দিতে হবে নাকি? 

       - বিসর্জন তো দিয়েছিই। তুমিও দিয়েছ, আমিও দিয়েছি। আবার মা-ও দিয়েছে।  তা না হলে তো বাল্যবিধবা পিসিমাও নতুন পিসেমশাইকে  বিয়ে না করে কাশীর নোংরা পাড়ায় পচতে থাকতো,আর মাকেও বাবার চিতায় পুড়িয়ে মারতে হতো আমাদের।  

               নিস্তারিণীদেবী আর পারলেন না। সক্রোধে বলে উঠলেন, "সেটাই উচিত ছিল। তাঁর সাথে স্বর্গে যেতে পারতাম। আজ আর এমন  হেনস্থা হতে হতোনা। তোদের কাছে এমন নরকযন্ত্রণাও  সহ্য করতে হতোনা। ওগো তুমি কাদের কাছে রেখে গেলে গো"

         - বিলাপ কোরোনা, কেউই এই পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গে যেতে চায়না মা।  তুমিও না।  যতই নরকতুল্য হোক, যতই দুঃখকষ্ট থাক না কেন সবাই  চায় এই পৃথিবীতে থাকতে, পৃথিবীটাকে ভোগ করতে। 

                 ছেলের সাথে তর্ক করা বৃথা। পাশে দাঁড়ানো নাতির দিকে ঘুরে বলে উঠলেন, এয়াই শয়তান, কি শুনছিস হাঁ করে? ছোটকাকার কথা খুব মন দিয়ে শুনিস, তাই না? খুব মিষ্টি লাগে? চলে আয় আমার সাথে।  নাড়ু বানাবো দেখবি।  ছোটোর সাথে একদম মিশবিনা।  নরকে যাবি। 

                এক মনে নাড়ু বানানো দেখতে দেখতে শয়তান বলল, "ঠাকমা,তুমি কি সত্যি সত্যি স্বর্গে যেতে চাও?"

            - স্বর্গে যেতে কে না চায় ভাই। সেখানে দেবতারা থাকেন। তোমার দাদুও থাকেন। আমিও তাঁদের কাছে যাবো। সেখানে না আছে কোন দুঃখ, না আছে কোনো জ্বালা যন্ত্রনা। শুধু অপার আনন্দ সেখানে। আমি পাপী, তাই এ বয়সেও পড়ে আছি এই পৃথিবীতে। মা কালীকে  সারাদিন ডাকি কোলে তুলে নিতে। কিন্তু আমার পাপের শেষ না  হলেতো তিনি নেবেননা।  পৃথিবীর যন্ত্রনা সইতে হবে। 

            - তুমি কি তাহলে আমাদের চেয়ে দেবতাদের বেশি ভালোবাসো ঠাকুমা?

            - ওরে আমার সোনাভাই, তা কখনো হয়! তুমি যে আমার নাড়ুগোপাল। 

            - শোনো ঠাকুমা, তুমি যখন স্বর্গে যাবে আমাকেও সাথে নিয়ে যাবে কিন্তু। আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারবো না। এই আমি বলে দিলাম সাফ কথা। 

             - বালাই ষাট, এমন কথা মুখে আনতে নেই। 

             - কেন? সবাইতো সে দেশে যেতে চায়। মজার জায়গা। মামাবাড়ীর থেকেও মজার।  তুমি এতো ভয় পেলে কেন।  স্বর্গে আমি যাবোই তোমার সাথে। 

       - ছি: ভাই, এমন কথা বলো না।  আমি বুড়ো হয়েছি।  আর কটা দিনই বা বাঁচবো।  তুমি এখন ছোট, কত বড় হবে, টুকটুকে বৌ আসবে, কত্ত আনন্দ করবে।  এখন এসব কথা ভাবতে নেই। 

        - তুমি যে বলো স্বর্গেই আনন্দ, পৃথিবীতে শুধু যন্ত্রনা। পাগলা বোঁচাও এ কথা বলে। 

        - বড়দের সাথে এমন মুখে মুখে তর্ক করতে নেই। ঠাকুর পাপ দেয়। এখন তুমি ছোট আছ্, বড় হলে সব বুঝতে পারবে। 

        - আমি ছোট বলে ঠাকুরের কথা, স্বর্গের কথা বুঝতে পারিনা, তবে সেসব কথা আমায় বোঝাও কেন? ঠাকুর দেবতাদের মূর্তিকে 'নমো কর নম্ কর' বলে প্রণাম করতে শেখাও কেন?

                উত্তর খুঁজে না পেয়ে যেন কিছুই শোনেননি ভাব দেখিয়ে উঠে গেলেন ঠাকুমা অন্তরের রাগ চেপে। আজকালকার এতটুকু বাচ্চাদের সাথে কথায় পারা যায়না।  শুধু প্রশ্ন, আর প্রশ্ন। সক্রেটিস থেকে অমর্ত্য সেনরা ওদের শেষ করে দিলো। 

             দেখতে দেখতে কালীপূজার দিন এসে গেল।  নাস্তিক হলে কি হবে, ছোট কাকার কালীপূজায় খুব উৎসাহ। পাঁঠার মাংসের ওপর ওর একটু দুর্বলতা  আছে। শয়তানকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই  ঠাকুর কিনে নিয়ে এলো পছন্দ করে। ও অবশ্য মূর্তিটিকে পুতুল, আর পুজোকে পুজো-পুজো খেলা বলে।  ছাতের ওপর নিজের হাতে তৈরী করে প্যান্ডেল।  আর্টিস্ট মানুষ, সাজিয়েছে সুন্দর। ঠাকুরের মুখের খুঁতটা তুলি দিয়ে ঠিক করে দিল। শয়তান তার প্রিয় কাকুকে সাহায্য করে রং, তুলি, কাঁচি ইত্যাদি জিনিস এগিয়ে দিচ্ছে। ঠাকুমা ফল কাটছেন, নৈবেদ্য সাজাচ্ছেন। শয়তানের মা মশলা বাটছেন আগামীকাল বলির মাংসপ্রসাদ রান্নার জন্য। ঠাকুর সাজাতে সাজাতে শয়তানের এটা ওটা হাজার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে তার ছোটকাকু। মা কালীর মুখটা রক্তাক্ত কেন, তিনি কি কাঁচা মাংস খান? তিনি কি আফ্রকার মেয়ে? 

               ঠাকুমা কি জন্য একটা কাজে নিচে গেলেন। শয়তানকে বলে গেলেন নজর রাখতে যেন কাকেরা নৈবেদ্যে মুখ না দেয়।  

                ছোটকাকু ঠাকুর সাজাতে সাজাতে বললো, দেখলি শয়তান, মা কালী নিজের খাবারটাও বাঁচাতে পারে না সামান্য কাকের থেকে।  যেটা তুইও পারিস।  এটা তোর ঠাকুমাও  জানে। শুনেছি সবচেয়ে বড় কালীঘাটের কালীর সোনার জিভটা চোরে খুলে নিয়ে গেছে। এই ঠাকুর নাকি বড় বড় শত্রুদের হাত থেকে আমাদের বাঁচাবে!

                শয়তান হঠাৎ করে তোতা পাখীর মত খুব গম্ভীর হয়ে বললো, "তুমি আমার সাথে এমন কথা বলবেনা। ঠাকুমা শুনতে না করেছে। শেষ পর্যন্ত আমি নরকে যাবো নাকি?" একেবারে ঠাকুমার ভাষা। 

                  ওর বলার ভঙ্গি দেখে অজিত হো হো করে হেসে উঠলো। এমন সময় নিস্তারিণী দেবী ফিরে এলেন।  অজিতকে বললেন, "আজকের দিনটা রেহাই দে বাবা। ওর নামে উৎসর্গ করা পূজা।  ওর মাথাটা আর খাসনা। 

                

গভীর রাতে পুজো।  চারিদিকে একটা ভয় ভয়,ভক্তি ভাব। পুরুত ঠাকুরের চোখ রক্তবর্ণ।  প্রচুর কারণবারি পান করেছেন।  পরনে লাল চেলী।  কপালে বড় একটা লাল তেলতেলে টিপ।  গলায় জবাফুল ও রুদ্রাক্ষের মালা।  বিখ্যাত তান্ত্রিক সাধক। নরবলি দেওয়া  মড়ার ওপর বসে কালীসাধনা করে 'সিদ্ধ' পুরুষ হয়েছেন বলে আধ্যাত্মিক গুজব।   

                অনেক সময় নিয়ে তিনি গুরুগম্ভীর গলায় নানা অঙ্গভঙ্গি করে  পূজার্চনা ও মন্ত্রপাঠ করলেন দক্ষ অভিনেতাদের মত। এবার বলি হবে।  কালো কালো নধর দুটি ছাগশিশু দু তিন দিন আগে রাজাবাজারের পাঁঠাবাজার থেকে এসেছে। ছাগলদুটিকে ভালোবেসে ফেলেছে শয়তান। পার্ক থেকে ঘাস ছিঁড়ে এনে খাইয়েছে, পাউরুটি খাইয়েছে। ওদের বলি হয়ে যাবে এখুনি। শয়তানের মন তাই খারাপ। তার দুদিনের বন্ধু আজ মরে গিয়ে কালীঠাকুর আর তাঁর ভক্তদের পেটে ঢুকবে। 


        ছাগলদুটিকে চান করিয়ে নিয়ে আসা হলো। তাদের গলায়ও জবার মালা। কপালে লাল টিপ্।  শয়তান ওদের অবস্থা দেখে চোখে আর জল রাখতে পারছেনা।  ওদের প্রাণ বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিল শয়তান।  বাবা,মা,ছোটকাকু কেউ ওর কথা শোনেনি।  ঠাকুমাকে বলেছিল, "ওদের না মারলে হয়না?" 

           ঠাকুমা ওর মুখ চেপে ধরে বলেছিলো, "ওকথা বলতে নেই, মাকালী পাপ দেবেন "


            শয়তান বললো, "ওরা কি দোষ করেছে যে ওদের গলা কেটে ফেলা হবে?"


            ঠাকুমা বললো, "ওরে বোকা, ওরা অনেক ভাগ্যবান। মা ওদের গ্রহণ করবেন। ওরা স্বর্গে যাবে।  ওদের জীবন স্বার্থক"

             প্রচণ্ড জোরে ঢাক বাজছে। ছাগলদুটির মাথা একসাথে হাড়িকাঠে ঢোকানো হলো।  চিতায় জোর করে বাঁশ দিয়ে চেপে ধরা সতীদের আর্তনাদ যেমন ঢাকের আওয়াজে ঢাকা পড়ে যেত, ছাগলগুলির ব্যা ব্যা শব্দও চাপা পড়ে যাচ্ছে।  

            শয়তান আর থাকতে পারছেনা। খুব জোরে জোরে নিঃস্বাস নিচ্ছে। বুকটা বোধ হয় ফেটে যাবে তার।  এমন সময় বিকট শব্দে "মা মা" বলতে বলতে বিশাল খাঁড়া হাতে মাতাল সিদ্ধ পুরুষটি এক কোপে কেটে ফেললেন ছাগল দুটিকে।  কাটা ধড় দুটো ছটপট করতে লাগলো মাটিতে লুটিয়ে। একবার চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেল শয়তান।  

                   

 চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে ওর ঠাকুমা ওকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে শুয়ে পড়লেন। শয়তানকে বললেন,"ছাগলদুটোর কি ভাগ্য! মা কালী ওদের দেহ ভোগ করলেন। আমরা কালকে মায়ের প্রসাদ খাবো। ওরা স্বর্গে চলে গেল।  ওদের জন্য  দুঃখ করতে নেই।"

       - তাহলে তোমাকেও বলি দিতে ঐ রাক্ষস পুরুতটাকে বললেনা কেন? তুমিওতো স্বর্গে যেতে চাও।  কালকে পুরুতকে বলে আমি তুমি দুজনেই বলি হয়ে স্বর্গে চলে যাবো" 

              এ কথা শুনে ঠাকুমা ভয়ে আঁতকে উঠলেন। ছেলে বলে কি। ঠাকুমা উত্তরহারা। শেষ রাতে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লেন। 

                ভোরবেলা হঠাৎ ঢাকের শব্দ আর ঠাকুমার ভয়ার্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল শয়তানের। ঘুমের ঘোরে ঠাকুমা হাড়িকাঠে ঢোকানো পাঁঠার মত আর্ত চিৎকার করে বলছেন, "আমায় বলি দিওনা, আমি স্বর্গে মা কালীর কাছে যাবোনা, আমি এই পৃথিবীতেই থাকতে চাই"।  

                শয়তান ঠাকুমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, "কেঁদোনা ঠাকুমা, আমি আর স্বর্গে যেতে চাইনা। তুমিও যাবেনা, আমিও যাবনা, কালীর প্রসাদও খাবনা " 

         হুঁশ পেয়ে ঠাকুমা বললেন, আজ থেকে তিনি পুজো আচ্ছা ছেড়ে দেবেন। স্বর্গের স্বাদ তাঁর মিটে গেছে।  ঠাকুমার কথা শুনে দরজায় দাঁড়ানো অজিত হাততালি দিতে লাগলো  হাসতে হাসতে। 

মূল রচনা - কলকাতা ডিসেম্বর ১৯৯৫

সামান্য সংশোধিত -  সানফ্রান্সিসকো - ২০১৮ 

সমালোচনা:   asokdas.godless@gmail.com

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929